বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রাচীন ঐতিহ্য। এর নামকরণ বিশাখা নক্ষত্র থেকে। সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক বাংলা পঞ্জিকা চালু করেন, পরে সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তা সংস্কার করেন। তখন ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে পঞ্জিকা চালু হয় এবং চৈত্র মাসের শেষে কৃষকদের খাজনা দিতে হতো। এ উপলক্ষে তিনি মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করতেন। ব্যবসায়ীদের হালখাতা শুরু হয় তখন থেকেই।
সোনারগাঁয়ে ঈসা খাঁর আমলে বউ মেলার প্রচলন ছিল, যেখানে নারীরা বটতলায় পূজা করতেন এবং পাঁঠা বলি দিতেন। এখন সেখানে পায়রা উড়িয়ে শান্তির বার্তা দেওয়া হয়। সোনারগাঁয়ে ঘোড়া মেলারও চল ছিল। যামিনী সাধন নামে এক ব্যক্তি নববর্ষে ঘোড়ায় চড়ে প্রসাদ দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও মেলার সূচনা হয়। তখন থেকে মেলায় মাটির ঘোড়া, নাগরদোলা ও ঘূর্ণি দোলনার রীতি চালু হয়।
ইতিহাস থেকে এবার চলে আসি এ বছরের বৈশাখ উদ্যাপনে। বিগত কয়েক বছরে করোনা ও রোজার কারণে পয়লা বৈশাখ আয়োজনে কিছুটা ভাটা ছিল। এবারের আয়োজন এ জন্যই ছিল উৎসবমুখর; শহরজুড়ে প্রতিটি এলাকায়, অলিগলিতে আয়োজিত হয়েছে নববর্ষ। চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যা থেকে বৈশাখের দিন এবং এর পরেও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চলেছে মেলা।
গুলশানের সাহাবুদ্দীন পার্কের গুলশান সোসাইটির নিবেদনে বর্ষবরণ বন্ধুগণের আয়োজনে অলিগলি হালখাতার এই আয়োজন গত বছর প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ছিল এক দিনের। গতবারের সাফল্যেই এবারের আয়োজনের পরিসর বেড়েছে। এক দিনের পরিবর্তে হয়েছে দুই দিন। গেলবারের মতো এবারও এই আয়োজনের অংশ ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ। ১৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু হয় মেলা। অংশ নেওয়া ৯ ধরনের কারুশিল্পী ও তাঁদের কারুপণ্য যেমন ছিল, ছিল দেশীয় উদ্যোক্তাদের পোশাকও। সন্ধ্যায় ছিল ইসলাম উদ্দিন পালাকারের গান। আর রাতে হয়েছে আলপনা। রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আলপনা।
নানা বয়সী মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। এর উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোশনের প্রশাসক এজাজ আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, গুলশান সোসাইটির সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর সাদাত, সহসভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, মহাসচিব সৈয়দ আহসান হাবিব ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক শ্রাবন্তী দত্ত এবং অলিগলি বর্ষবরণ বন্ধুরা। পয়লা বৈশাখের দিন সকাল থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সারা দিন নানা আয়োজনে মুখর ছিল পার্ক। এবার লোকসমাগম হয়েছে গতবারের চেয়ে তিন গুণ।
পরদিন সকালে দেখা গেল গুলশান–২ থেকে শাহাবুদ্দিন পার্ক পর্যন্ত আলপনা। নানা বয়সী মানুষ রঙিন পোশাক পরে ছবি তুলছেন। পয়লা বৈশাখের দিন পরিবার–পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা মানুষের ভিড় ছিল লক্ষণীয়।
নববর্ষের দিন উৎসব শুরু হয় সকাল থেকেই। সকাল নয়টায় র্যাচেল প্রিয়াঙ্কা ও তাঁর দলের বর্ষবরণ নৃত্যের মাধ্যমে দিনের আয়োজন শুরু হয়। এরপর অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম এবং গুলশান সোসাইটির কর্মকর্তা ও অলিগলি-বর্ষবরণ বন্ধুরা। এরপর জলের গানের পরিবেশনায় জমে ওঠে ‘গানালাপ’।
জলের গানের পর ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান ভাবালাপ। ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ও জনপরিসরে নারী’ শীর্ষক এই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক সাইদ ফিরদৌস, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, সংস্কৃতিকর্মী সারা জাকের, অধ্যাপক সালিমা সুলতানা ও অধ্যাপক মিথিলা মাহফুজ ও আদিবাসী অধিকারকর্মী ডালিয়া চাকমা।
সমান্তরালে চলে চিত্রালাপ। অংশ নেন দেশের শীর্ষ সারির ১২ জন চিত্রশিল্পী। দুপুরের বিরতির পর ছিল ছোটদের নৃত্যানুষ্ঠান, ‘সব সখী মিলে গাই মঙ্গল গান’ ও সমগীতের পরিবেশনা। আর এবারের আয়োজন পর্দা নামে রাতে বাপ্পা মজুমদার ও দলছুটের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
পার্কের বিভিন্ন অংশ সাজানো হয় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। হাটবাজারের ছিল বেনেবৌ, অনুভা, মিতার গল্প, তানাস ক্রিয়েশন, রঙ্গিন সুতা, রিঙ্কিস অ্যাটায়ার, আজুরা, কারুজ, ক্লে স্টেশন, ওয়ান ক্র্যাফট। মেলায় যাঁরা এসেছেন, তাঁরা পণ্য কেনার পাশাপাশি স্বচক্ষে দেখতে পেরেছেন কারুশিল্পীদের হাতে–কলমে কাজ। বোনা হচ্ছিল মিরপুরের বেনারসি ও জামদানি। আরও ছিল মুন্সিগঞ্জের শীতলপাটি, সোনারগাঁর খেলনা, চাঁপাই নবাবগঞ্জের সুজনী কাঁথা, নারায়ণগঞ্জের সুতার হাতপাখা, সোনারগাঁর কাঠখোদাই, নরসিংদীর বাস্কেট্রি ক্র্যাফটস ও রাজশাহীর শখের হাঁড়ি।
চকবাজারে খাওয়াদাওয়া, শিশুদের জন্য মোজো পার্কে হইহুল্লোড়, চা-আইসক্রিম-চটপটি টেস্টিং, একটু পরপরই সুন্দর সুন্দর ফটো বুথে ছবি ও সেলফি তোলার ব্যবস্থা ছিল, বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলা। হাজার হাজার মানুষ এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আসেন উপভোগ করতে। এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক ছিল ইউসিবি ব্যাংক ও এশিয়ান পেইন্টস। পার্টনার ছিল মোজো, বিকাশ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, কনকর্ড, পোলার, ফিনলে, ফাইভ আর–সিকিউরেক্স কনসোর্টিয়াম ও ব্র্যান্ড কার্ট।
শহুরে আধুনিকতার সঙ্গে বৈশাখ ঐতিহ্যের সম্মিলনে অনুষ্ঠিত হয় চার দিনের রিশকা কানেক্টসের আয়োজনে রিশকা ফেস্টিভ্যাল। তেজগাঁও–গুলশান লিংক রোডের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে এই আয়োজনে ছিল তরুণদের উপচে পড়া ভিড়। চার দিনের আয়োজনে বৈশাখের এই ফিউশন আঙ্গিক ভালো লেগেছে বলে জানান অনেক দর্শনার্থী। উদ্যোক্তাদের পণ্য নিয়ে দ্য বাজার, দেশীয় কারুশিল্পীদের পণ্য নিয়ে দ্য মেলা আর আলোকির গ্লাস হাউসে শিল্পঘরে দেখা গেল ক্রেতার ভিড়।
আলোকির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তৈরি মঞ্চে প্রতিদিনই ছিল নানা ধরনের আয়োজন। বাউল গানের আসর ছাড়াও ছিল নেমেসিস, ফিরোজ জং ও কাকতালের পরিবেশনা। আরও ছিল মিম আর্ট, স্ট্যান্ড আপ কমেডি, জাদু প্রদর্শনী ও বিট্মোস্ফেয়ারের পরিবেশনা। গান পরিবেশন করে দ্য পোয়েট, অর্জুন কর, স্পেস পাইপার ফিচারিং একেএস অ্যান্ড পিয়ুস, তপেস চক্রবর্তী, সরোদ ফুলঝুরি সিস্টার্স, দ্য রি রি। এথনিক ড্যান্সার পরিবেশন করে মণিপুরি নৃত্য, দ্য রিদম অব সোলের পরিবেশনায় ছিল ক্লাসিক্যাল নাচ। এ ছাড়া ছিল দ্য রেনেসাঁর পরিবেশনা।
আলোকির দোতলায় ছিল বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা ও চলচ্চিত্র; দেখানো হয়েছে লালসালু, পথের পাঁচালি, বেদের মেয়ে জোছনা ও মাটির ময়না। প্রাচ্যনাটের পরিচালনায় ছিল থিয়েটার আর্ট। ইকেবানা, মুখোশ তৈরি ও আঁকার, আলপনা ও অরিগামির কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোট ৫৪ জন উদ্যোক্তা অংশ নেয় দ্য বাজারে। গ্লাস হাউসে দেশীয় পণ্যের পসরা নিয়ে এসেছিলেন ১২ জন কারুশিল্পী; যেমন টেপা পুতুল, শীতলপাটি, শলার পণ্য, শতরঞ্জি, কাঁসার পণ্য ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশীয় ও কন্টিনেন্টাল খাবারের সমারোহ ছিল ১৬টি স্টলে। আলোকির সামনের প্রাঙ্গণে ছিল নাগরদোলার।
রিশকা কানেক্টসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও হেড অব স্ট্রাটেজি রাশিক রাব্বানী বলেন, ‘গত নভেম্বরে রিশকা ফ্যাস্টিভ্যাল আয়োজনের পর ব্যাপক সাড়া পাই। তখন থেকেই বৈশাখ মাথায় রেখে এই আয়োজনের পরিকল্পনা করি। এখানে প্রবেশের জন্য টিকিট ছিল জনপ্রতি ৩০০ টাকা। এ ছাড়া দোতলায় ছবি দেখা ও গান শোনার জন্য ছিল আলাদা টিকিট।’
যাত্রাবিরতিতে প্রতিবছর বৈশাখে থাকে বিশেষ আয়োজন। এবারের বর্ষবরণ উদ্যাপিত হয় দুই দিন পয়লা বৈশাখ ও পরের দিন। বেশ ছিমছাম গোছানো আয়োজনে ছিল গ্রামীণ মেলার আবহ। ছিল ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, ভাগ্য গণনা, মুখে আলপনা আঁকা, কুস্টিয়ার কুলফি খাওয়ার ব্যবস্থা ও বাউলগান। লোকজ পণ্যের সমাহার দেখা গেছে। ছিল বাঁশ ও বেতের পণ্য, মাটির খেলনা, গামছা, কাঠের গৃহস্থালি পণ্য। নারী অতিথিদের জন্য ছিল চুড়ি কেনার আয়োজন, ১৪ ও ১৫ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই উৎসবে প্রথম দিনের সন্ধ্যায় সংগীত পরিবেশন করে ব্যান্ড লেমনেড ও প্লাস্টিক আর্কেড এবং শেষ দিন ছিল ব্যান্ড কৃষ্ণপক্ষের পরিবেশনা। চৈত্রসংক্রান্তিতে যাত্রাবিরতিতে কাকতাল এবং আকাশ গায়েনের (গানকবি) পরিবেশনা ছিল। পয়লা বৈশাখের বিশেষ আকর্ষণ ছিল লাঠিখেলা।
যাত্রা বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ইমতেনান মোহাম্মদ বলেন, যাত্রাবিরতি সব সময় বাঙালির সৃজনশীলতাকেন্দ্রিক উৎসবগুলোর পাশাপাশি নিয়মিত গানের আয়োজন করে। এবারের মেলায়ও সেই প্রয়াস ছিল। ৫০০ টাকার টিকিটের সঙ্গে সবকিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাত দিনের বৈশাখী মেলা পয়লা বৈশাখে শুরু হয়েছে। শেষ হচ্ছে আজ রোববার। মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। মেলায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের পণ্যসহ রকমারি পণ্য নিয়ে ৯৮টি স্টল আছে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, কুটির ও হস্তশিল্পসহ নানা রকমের সামগ্রী। মেলায় ছিল যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, সার্কাস, নাগরদোলাসহ বিনোদনের নানা আয়োজন। মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সব দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
এসব আয়োজন ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছিল বৈশাখের আয়োজন। গুলশান তাজউদ্দীন পার্ক, উত্তরা, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর, মোহাম্মাদপুরসহ শহরের বিভিন্ন অলিগলি আর পাড়া-মহল্লায় মহা উৎসাহে বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে।
ছবি: অলিগলি, কেয়া হাবিব, শিশির চৌধুরী