যেভাবে নেতিবাচক অনলাইন-সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকবেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ভিডিওসাইটে হঠাৎ তুমুল ভাইরাল হয়ে যায় মিথ্যা সংবাদ, টুকরো জুড়ে বানানো ভিডিও বা কেটে-ছেঁটে ফটোশপ করা ছবি। হাজারে-বিজারে লাইক ও শেয়ার হতে থাকে যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কিছু। মুহূর্তের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। আমরা এসব কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এর সত্যতা যাচাই বা এর পরিণাম সম্পর্কে ভেবে দেখার কথা মনেও আনি না। সমাজে সবার এই জিঘাংসু আচরণ দিন দিন বেড়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে। এমপ্যাথি বা মানবিক সহমর্মিতা নেমে গেছে এখানে একেবারেই শূন্যের কোঠায়।

আমরা প্রতিনিয়ত নানা মাধ্যম থেকে বিভিন্ন ধরনের খবর পাই। দেশ, বিদেশ, সমাজ, সংসার, আত্মীয়, বন্ধু সবার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারি আমরা। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, কোন সংবাদগুলো আমাদের মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করে। কোন সংবাদগুলো নিয়ে আমরা বেশি আলোচনার ঝড় তুলি, তা খেয়াল করে দেখা প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

হিউম্যানিটিস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস কমিউনিকেশনের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মিথ্যা তথ্য আর ঘৃণা ও উসকানিমূলক বক্তব্য বা হেট স্পিচই আমাদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। অথচ এসব খবর মিথ্যা বা ভুয়া কি না, তা আমরা ভেবেও দেখি না। এ যেন চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পেছনে দৌড়ানোর মতো অবস্থা। এর সহজ উদাহরণ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও সম্পর্কে যেকোনো মিথ্যা ও নেতিবাচক তথ্য কেউ প্রচার করলে, তা নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট হতে থাকে।

যেকোনো ধরনের হেট স্পিচও সেখানে ছড়ায় দাবানলের মতো। কিন্তু কারও ব্যাপারে ভালো কথা, সুখের কথা, কিংবা কোন হিতকর বা জ্ঞানগর্ভ লেখা পোস্ট করলে দেখা যাবে, খুব কম সাড়া মেলে বা সহজেই তা হারিয়ে যায় সময়ের সঙ্গে। এমনিতেও বন্ধু বা আত্মীয়দের কোনো সুসংবাদ বা কৃতিত্বের খবরের চেয়ে তাদের কোনো অশুভ বা খারাপ খবর পেলে আমরা কে কার আগে কতজনকে তা জানাতে পারি এবং তা নিয়ে চর্চা করতে পারি, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এসব কাজ যে ভালো নয়, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা ভাবি, আমরা তাদের চেয়ে ভালো মানুষ বা তারা নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় করেছে, তাই তাদের সঙ্গে অশুভ কিছু ঘটছে। হিংসাত্মক মনোভাবের কারণে খবরটি মিথ্যা বা পুরো সত্য কি না, তা জানার চেষ্টা আমরা করি না। আসলে পরচর্চা করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না আমরা।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি ৯২ হাজার ১১২টি ভুল তথ্যসংবলিত খবরকে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি ভাগ করেছেন। এগুলো হচ্ছে—কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্রমূলক রটনা, হেট স্পিচ বা বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য, ফেক নিউজ বা মিথ্যা ও অর্ধসত্য তথ্য, গার্বেজ সায়েন্স বা অসত্য ও ভিত্তিহীন বৈজ্ঞানিক তথ্য, রিউমার বা গুজব আর ক্লিকবেট। এই ক্লিকবেট কথাটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য এক মিথ্যার ফাঁদস্বরূপ। কিছু ইন্টারনেট পেজে এমন সব তথ্য দেওয়া হয়, যা মিথ্যা। কিন্তু মানুষ এর পরিবেশনা বা ইঙ্গিতবহ শিরোনাম ও থাম্বনেল দেখে সেই পেজে ক্লিক করে। এগুলোকেই ক্লিকবেট বা ক্লিকের টোপ বলা হয়।

গবেষণা বলে, মিথ্যা ও নেতিবাচক কনটেন্ট ও সংবাদের তুলনায় যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যবহুল বিষয় প্রসেস করতে আমাদের মস্তিষ্কের কগনিটিভ এফোর্ট বেশি দিতে হয়, অর্থাৎ বেশি কাজ করতে হয়। কারণ, সত্য সংবাদ বা ঘটনার লেক্সিক্যাল ডাইভার্সিটি বা আভিধানিক অর্থের চেয়েও গভীর অর্থ থাকে এসব ফেক নিউজের চটকদার শিরোনাম ও পরিবেশনা গ্রহণ করতে প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, সত্য সংবাদের চেয়ে ভুয়া খবর ৩৭ শতাংশ আর হেট স্পিচ ৫০ শতাংশ বেশি আবেদন রাখে আমাদের কাছে। অর্থাৎ মিথ্যা সংবাদ বা ঘটনা শুনতে, জানতে এবং চর্চা করতে আমাদের বেশি ভালো লাগে।

তাই তো সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় কোনো দেশের মানুষ মারা গেলে আরেক দেশের মানুষ হাত তুলে নৃত্য করতে পারে। এ জন্যই এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে মেরেছে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মনে মনে স্বধর্মের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অন্য ধর্মের মানুষকে মারার চিন্তা করি বা সমালোচনার ঝড় তুলি। আবার কোনো ঘটনা ঘটলে তার সত্যতা যাচাই না করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, নানান অপবাদ দিই, কী দণ্ড দেওয়া যায়, তা নির্ধারণ করি। কিন্তু এগুলো করে আমরা শুধু আমাদের সীমিত জ্ঞানের বা বোধের মাত্রাই প্রকাশ করি।

আমরা যদি এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলে খারাপ সংবাদগুলো বা বিদ্বেষমূলক কনটেন্টগুলো যাচাই না করে গ্রহণ করা বন্ধ করে দিই, তবে তা আমাদের সমাজেই শান্তি আনবে। যেকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সহিংস প্রতিবাদের ঝড় তোলার আগে, দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে, দলে দলে পোস্ট করার আগে, পোস্টের উত্তর দেওয়ার আগে, একটু চিন্তা করতে হবে যুক্তি দিয়ে। সঠিক পদ্ধতিতে খোঁজ নিতে হবে ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে। এতে করে নিজেদের বিভ্রান্তি এবং অন্যায় কাজ থেকে রক্ষা করা যাবে। বাঁচবে পৃথিবীও।

ছবি: হাল ফ্যাশন ও পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৩, ১৪: ২৫
বিজ্ঞাপন