আমরা কি গ্রাফিতি আঁকছি, নাকি মুছে ফেলছি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

গ্রাফিতি শব্দটি এখন এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। সারা দেশ সেজে উঠছে রংবেরঙের দেয়াললিখন ও ছবিতে। সবাই নিজের দেশ ও শহরকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার আগ্রহে কাজ করে চলেছেন তুমুল আগ্রহে। এটি একটি আশার কথাই বটে। তবে গ্রাফিতি আসলে কী? এখন দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পটু আর অপটু হাতে করা যেসব রঙিন ছবি ও লেখা, এর সবই কি এক দাগে গ্রাফিতির কাতারে ফেলা চলে? নাকি যেসব স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী লেখা মুছে সেখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকাআঁকি চলছে, তার সবই সত্যিকারের গ্রাফিতি?

দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পটু আর অপটু হাতে করা যেসব রঙিন ছবি ও লেখা
দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পটু আর অপটু হাতে করা যেসব রঙিন ছবি ও লেখা

ইতালীয় শব্দ ‘গ্রাফিও’ থেকে গ্রাফিতি শব্দের উদ্ভব। গ্রাফিও মানে হচ্ছে স্ক্র্যাচ, যাকে সোজা বাংলায় আঁচড় বা দাগ বলে। এ তো গেল ইতিহাস। সত্যি বলতে গ্রাফিতি কিন্তু একটি বিতর্কিত আর্ট ফর্ম। এটি একটি যোগাযোগের মাধ্যমও বটে। সাধারণত এমন কোনো জায়গা, যা সবার দৃষ্টিগোচর হবে, সেখানে  অননুমোদিত চিহ্নিতকরণই গ্রাফিতি। লোকে বলে, গ্রাফিতি নাকি একসময় আঁকা হতো রাতের অন্ধকারে কিংবা শত্রুর বন্দুকের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে! রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো প্রেক্ষাপটেই গ্রাফিতি করাটা গ্রাফিতির মূল লক্ষ্য। আর যেহেতু রাতের অন্ধকারে বিতর্কিত বিষয়গুলো অননুমোদিতভাবে তড়িঘড়ি করে তুলে ধরা হতো, তাই গ্রাফিতিতে নানা রঙের ব্যবহার তেমন ছিল না বললেই চলে। স্প্রে পেইন্টেই করা হতো বেশির ভাগ গ্রাফিতি।

গ্রাফিতিকে বেশ বিদ্রোহী একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে ধরা যেতে পারে
গ্রাফিতিকে বেশ বিদ্রোহী একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে ধরা যেতে পারে

গ্রাফিতিকে বেশ বিদ্রোহী একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে ধরা যেতে পারে, যার মূল কাজ হচ্ছে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা। কোনো কিছুকে গ্রাফিতির কাতারে পড়তে হলে তাকে হতে হবে জোরালো প্রতিবাদের প্রতীকী চিহ্ন বা শক্তিশালী কোনো মেসেজের ধারক। শুধু ভোকাল কর্ডে জোর দিয়ে আওয়াজ তুললেই যে তা প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা হতে বাধ্য নয়, বরং লিখে ও এঁকে, ব্যঙ্গ বা সূক্ষ্ম সার্কাজম করেও যে প্রতিবাদ জানানো যায়, তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে গ্রাফিতি।

বিজ্ঞাপন

গ্রাফিতির নাম এই শহরে আগেও শোনা যেত। ‘সুবোধ, তুই পালিয়ে যা’ শীর্ষক বিভিন্ন গ্রাফিতির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে হালের ক্রেজ এই গ্রাফিতির  ইতিহাস আজকের নয়। প্রায় চার হাজার বছর আগে রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিস্থলগুলোতে গ্রাফিতির খোঁজ পাওয়া যায়। গ্রাফিতি তার ছাপ ফেলে এসেছে  ১৬ শতকের স্পেনের পাথরে ও গির্জার দেয়ালগুলোতেও।  ইদানীংয়ের গ্রাফিতি পাশ্চাত্য থেকে অনুপ্রাণিত। বিশেষত ইউরোপ আর আমেরিকা। আমেরিকার হিপহপ স্টাইলের গ্রাফিতিগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এসব গ্রাফিতি সাধারণত করা হতো সাবওয়ে, বিলবোর্ড ও দেয়ালে। কখনো শহীদদের স্মরণে, কখনো অঞ্চলের সীমানা দাবি করতে, আবার কখনো বা সংঘর্ষের ইতিহাস মনে রাখতে, অভিবাসনের সমস্যা তুলে ধরতে কিংবা বিপরীত পক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও এসব গ্রাফিতি ভূমিকা রেখে এসেছে ইউরোপের বিভিন্ন বিপ্লবে।

যেকোনো বিপ্লবের পালে হাওয়া দিয়ে প্রভাব রাখে এই সাহসী শিল্পকর্ম
যেকোনো বিপ্লবের পালে হাওয়া দিয়ে প্রভাব রাখে এই সাহসী শিল্পকর্ম

যেকোনো বিপ্লবের পালে হাওয়া দিয়ে গতিবিধিতেও প্রভাব রাখে এই সাহসী শিল্পকর্ম। মোদ্দা কথা, গ্রাফিতিকে হতে হয় শক্তিশালী। গ্রাফিতি ভাবগম্ভীর এক কলা অথচ এতে স্ল্যাং, আপত্তিকর শব্দ আর বিদ্রূপ থাকে ভরপুর। এরপরও এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। একে তুচ্ছ করার সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

গ্রাফিতির ইতিহাস ঘেঁটে এ কথা সহজেই বুঝতে পারা যায় যে এখন শহরের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়া সব রঙিন ছবি গ্রাফিতি নয়। তবে এর অনেকগুলোই শিল্প, প্রতিবাদের মাধ্যম আর গণ–অভ্যুত্থানের নজির। ছবি এঁকে, বিপ্লবের সঙ্গে মিশে আছে এমন গুরুত্বপূর্ণ উক্তি বা কথাগুলো লিখে কিংবা হাস্যরসের আশ্রয় নিয়ে জটিল কথাকে মিমের মাধ্যমে সহজভাবে উপস্থাপন করে অনেক মুশকিল আসান করেছে এই জেন-জি জনতা। যারা গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলতে পারে ২০ দিনের ব্যবধানে, তাদের সৃজনশীলতাকে প্রশ্ন করা হয়তো যায় না সহজেই। তবে গ্রাফিতি ও চিত্রকর্ম আলাদা। এ কথা মানতেই হয়।

শহরের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়া সব রঙিন ছবি এগুলোর মতো গ্রাফিতি নয়
শহরের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়া সব রঙিন ছবি এগুলোর মতো গ্রাফিতি নয়

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে বন্দুকের গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর পুলিশি ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের মারণ হামলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেসব অরিজিনাল দেয়াললিখন করা হয়েছে, সেগুলোই কি সত্যিকারের গ্রাফিতি নয়? তাহলে কেন এগুলোর অস্তিত্ব মুছে দিয়ে আঁকতে হবে ফুল, লতা, পাখি অথবা হতে পারে তা এই বিপ্লবেরই সমার্থক! হয়তো ওই গ্রাফিতিগুলো আঁকা মানুষটি আর বেঁচে নেই। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বিপ্লব সফল করা সেই মানুষগুলোর শেষ চিহ্ন হতে পারে এই গ্রাফিতি। রংতুলি হাতে শহর রঙিন করার উৎসব মানেই গ্রাফিতি নয়। বরং আমরা গ্রাফিতি করতে গিয়ে গ্রাফিতি মুছে অন্য কিছু আঁকছি।

মারণ হামলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেসব অরিজিনাল দেয়াললিখন করা হয়েছে, সেগুলোই কি সত্যিকারের গ্রাফিতি নয়?
মারণ হামলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেসব অরিজিনাল দেয়াললিখন করা হয়েছে, সেগুলোই কি সত্যিকারের গ্রাফিতি নয়?

শুধু গ্রাফিতি নয়, প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িত যেকোনো চিত্রকর্মই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই যাঁরা এসব কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তাঁদের একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের মানচিত্রের বিভিন্ন অপটু হাতে আঁকা দেয়ালচিত্র হচ্ছে ট্রলিংয়ের শিকার। দেখা মিলছে ‘নানা মুনির নানা মত’–এর। এমনকি ছবিগুলো টুইটারে গুজবের জন্ম দিয়ে হয়েছে হাস্যরসেরও কারণ। দেশপ্রেমের আবেগ জড়িয়ে আছে যে তুলির আঁচড়ে, তা নেহাত ফেলনা নয়। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে মৌলিক বিষয়গুলো খেয়াল করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। তেমনই একটি ব্যাপার হচ্ছে গ্রাফিতি।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৬: ০২
বিজ্ঞাপন