অস্ট্রেলিয়ায় বাগান থেকে ফল তোলা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অস্ট্রেলিয়াতে বাগান থেকে উৎসব করে ফল তোলা হয়। তার জন্য বাগানমালিকদের পক্ষ থেকে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে টিকিট করে বাগান থেকে সরাসরি আপেল, কমলালেবু, চেরি ও গাব তোলা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে কমলালেবুকে ডাকা হয় ম্যান্ডারিন নামে। আর বাংলাদেশে যেটাকে আমরা মাল্টা বলি, সেটাকে এখানে বলা হয় অরেঞ্জ। বাংলাদেশে যেটাকে আমরা গাব নামে চিনি, সেটাকে এখানে ডাকা হয় ফুজি ফ্রুট বা পার্সিমন নামে। তবে এখানকার গাব আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বড় এবং এর মধ্যে বীজ থাকে না। আর খেতেও অনেক সুস্বাদু হয়।

গাছে ঝুলে আছে থোকায় থোকায় পার্সিমন
গাছে ঝুলে আছে থোকায় থোকায় পার্সিমন

প্রবাসে আসার পর সবাই কমবেশি ‘হোমসিকনেস’–এ ভোগে। প্রবাসের সবকিছুর সঙ্গে দেশের সবকিছুরই তুলনা চলে আসে নিজের অজান্তেই। এখানে আসার পর আমরা প্রথম আম কিনে খেয়ে দেখি, দেশের আমের মতো সুস্বাদু না। এরপর নেহায়েত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে প্রথম গাব বা পার্সিমন কিনেছিলাম। গাব চিনেছিলাম বোঁটার আকৃতি দেখে। কারণ, দেশে থাকতে কৈশোরে আমরা আমাদের বাড়ির পাশের হুদার বাগান থেকে গাব, সফেদা, কদবেল, চালতা চুরি করতাম। কখনো ভাবিনি যে এগুলো একসময় কিনে খেতে হবে।

বিজ্ঞাপন

পার্সিমন কিনে বাসায় এনে কেটে খেয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এরপর থেকেই আমরা প্রতি বছর নিয়মিতভাবে পার্সিমন কিনি। এরপর এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ‘সেডার ক্রিক অরচার্ড’–এর সন্ধান পাই। ওরা প্রতিবছরই একটা সময় বাগান থেকে পার্সিমন তোলার টিকেট বিক্রি করে। কিন্তু সেই টিকেটের চাহিদা এতোই বেশি যে বিক্রি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। এ বছরও প্রথমবার কোন টিকেট কিনতে পারিনি। পরে ওরা আবার টিকেট ছাড়ে, তখন আর দেরি করিনি।

চলছে ফলের রসের স্বাদ নেয়া
চলছে ফলের রসের স্বাদ নেয়া

এরপর রবিবার সকালবেলা বাংলা স্কুল শেষ করেই বাগানের উদ্দেশে রওয়ানা দিই। এই বাগানটার অবস্থান আমাদের বাসা থেকে গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের দূরত্বে। যাওয়ার রাস্তার দুপাশের দৃশ্য মনকে নিমেষে শান্ত করে দেয়। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সবুজের মধ্যে কোথাও গরুর পাল আবার কোথাও ঘোড়ার পাল; এমনকি কোথাও ছাগলের পাল বা ভেড়ার পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় এখন চলছে অটাম মানে বাংলার শরৎ বা হেমন্ত। ফলে শীতকে স্বাগত জানাতে গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। আর এই পাতা ঝরে পড়ার আগে বাহারি রঙ ধারণ করে। সেটা দেখতে খুবই সুন্দর।

বিজ্ঞাপন

বাগানের অফিসের সামনেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। সেখানে গাড়ি পার্ক করে আমরা টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। অফিসের সামনেই একটা বিশাল বড় চারকোণা আকৃতির টবে একটা পার্সিমন গাছ রেখে দেয়া হয়েছে। সেখানে ধরে আছে পাকা টসটসে কমলা রংয়ের পার্সিমন। আগের বুকিং দেখে সবাইকে সিনেমার টিকেটের মতো ছোট ছোট টিকেট দেয়া হচ্ছে। টিকেট নিয়ে আমরা আবার লাইনে দাঁড়ালাম ট্রাক্টরে ওঠার জন্য। মূল বাগানটা অফিস থেকে কিছুটা দূরে। এই জায়গাটুকু যেতে হয়ে ট্রাক্টরে চড়ে। এই ছোট ভ্রমণটুকু বাচ্চারা খুবই উপভোগ করে। একটু পরপরই সেখান থেকে ট্রাক্টরে করে মানুষকে বাগানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর ফেরত আনা হচ্ছে।

আছে একটু জিরিয়ে নেয়ার সুব্যবস্থা
আছে একটু জিরিয়ে নেয়ার সুব্যবস্থা

আমরাও একসময় ট্রাক্টরে উঠে বসলাম। বাগানের সামনে নামিয়ে দিলে একজন আমাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বিষয় জানিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমাদের বাগানের সব গাছই ‘নন-অ্যাস্ট্রিনজেন্ট’ পার্সিমন। অর্থাৎ এগুলো কাঁচা অথবা পাকা অবস্থায় চামড়াসহ যেকোন বয়সীরাই খেতে পারেন। তবে এগুলোর রং গাঢ় কমলা বর্ণের হলে খেতে সবচেয়ে সুস্বাদু হয়। আমাদের বাগানে দু–একটা ‘অ্যাস্ট্রিনজেন্ট’ প্রজাতির পার্সিমনের গাছ আছে। এরপর তিনি দুই ধরনের পার্সিমন হাতে নিয়ে আমাদের দেখালেন। যেটা আমরা তুলব, সেটা চ্যাপ্টা আকৃতির। যেটা আমরা তুলব না, সেটা হৃৎপিণ্ডের মতো আকৃতির। তবে ‘অ্যাস্ট্রিনজেন্ট’ প্রজাতিরটা না তোলাই ভালো।  কারণ, এটা পুরোপুরি না পাকলে খাওয়া যায় না।

ওনার বক্তব্য শেষ হবার পর আমরা বাগানময় ছড়িয়ে পড়লাম। আমরা তিনজন একটা লাইন বেছে নিয়ে বাগানে ঢুকে পড়লাম। মাঝের হাঁটাপথের দুপাশে পার্সিমন গাছের সারি। আর তাতে থোকায় থোকায় ধরে আছে অনেক পার্সিমন। আমরা বেছে বেছে কমলা রংয়েরগুলো তোলার চেষ্টা করলাম। তবে বেশ কিছু আধা সবুজ রংয়েরও তুলে ফেললাম। এরপর সেগুলো সঙ্গে আনা ব্যাগে জমাতে শুরু করলাম। থোকায় থোকায় পার্সিমনের এই ঝুলে থাকাটা দেখতে খুবই সুন্দর। গাছগুলোর আকৃতি মাঝারি। হাত দিয়েই মগডালের পার্সিমন পাড়া যায়। আবার পার্সিমনের ভারে কিছু ডাল বেঁকে এসেছে নিচের দিকে। ছোট রায়ান উৎসাহে গাছে চড়ে বসছিল।

বাগানের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই
বাগানের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই

এভাবেই একসময় আমাদের ব্যাগগুলো পার্সিমনে ভরে উঠলো। আপনি চাইলে বাগানে দাঁড়িয়েও পার্সিমনের স্বাদ নিতে পারেন। তারপরও আমরা কিছুক্ষণ বাগানের মধ্যে হেঁটে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বাগানের বাইরেই আবার ফিরে আসার জন্য ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রাক্টর আমাদের অফিসের পেছনের দরজায় নামিয়ে দিল। সেখানে বাগানের অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যের পসরা সাজানো রয়েছে। সেখান থেকেও পণ্য কেনা যায়। আর বিনা মূল্যে সেসব পণ্যের স্বাদ নেয়ার ব্যবস্থা আছে। আমরা তিনজন খুবই ছোট আকারের প্লাস্টিকের গ্লাসে করে আপেলের রসের স্বাদ নিলাম।

এরপর কাউন্টারে যেয়ে আমাদের পার্সিমন জমা দিলাম। আপনি আপনার ইচ্ছামতো পরিমাণের পার্সিমন কিনতে পারবেন। আমরা কিঞ্চিৎ বেশি তুলে ফেলেছিলাম। কাউন্টারে সেটা বলাতে বলল, কোন সমস্যা নেই। আমরা বাড়তি পার্সিমনগুলো রেখে দিচ্ছি।

সেডার ক্রিক অর্চার্ড– এর অফিস–কাম–বিক্রয়কেন্দ্র
সেডার ক্রিক অর্চার্ড– এর অফিস–কাম–বিক্রয়কেন্দ্র

এরপর দাম পরিশোধ করে আমরা কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসি। এখান থেকে পার্সিমন নেয়ার সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এগুলো একেবারে নিজের হাতে তোলা বাগানের সতেজ পণ্য। আর এগুলোর স্বাদও কেন জানি আলাদা মনে হয়। হয়তো–বা নিজের হাতে তোলা বলেই এমন হয়। কার পার্কের পাশের খোলা জায়গায় বসে বিশ্রাম নেয়ার সুব্যবস্থা আছে। আর অফিসের পেছনেই আছে প্রসাধনকক্ষ।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৩, ০৫: ০৯
বিজ্ঞাপন