ইতিহাস সাক্ষী আছে, মসলার সন্ধানে ইউরোপীয়রা কি তুলকালাম কান্ডটাই না ঘটিয়েছিল। মার্কিন মুলুককে ইন্ডিয়া নাম দিয়েও শেষ রক্ষা হল না কলম্বাসের। এদিকে ভাস্কো-দা-গামা আবার পেয়ে গেলেন মসলা-স্বর্গ ভারতবর্ষের সন্ধান। অন্যদিকে আরব দুনিয়ায় সাগরপথে মসলা পৌঁছে গেছে ততদিনে। এরপর মারামারি কাটাকাটি করে ইউরোপসহ তাদের সকল উপনিবেশে মসলা ছড়িয়ে গেল। সেই যুদ্ধ-বিগ্রহ থেমে গেছে। এমন কোন অঞ্চল নেই দুনিয়ায় যেখানে কোন না কোন মসলার ব্যবহার হয় না। মসলা কথাটির ব্যাপ্তিও কিন্তু অনেক। কত শত ধরনের যে মসলা আছে পৃথিবীতে তা গুণে শেষ করা যাবে না। হতে পারে তা গাছের শিকড়, বাকল, ডাল, পাতা, ফুল, ফল, বীজ-যেকোন কিছুই।
কি যাদু এই মসলায়, যে তা নিয়ে এত কিছু! ফ্লেভার বা টেক্সচার- এই কথাগুলো আসলে বুঝিয়ে বলা কঠিন। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়েই বুঝতে হয় মসলার ব্যাপারগুলো। খাবারের স্বাদ, ঘ্রাণ আর টেকশ্চার নিয়ে খেলা করে মসলা। মাংসের বেলায় তো কথাই নেই। মাংস আর মসলা যেন দুজনে দুজনার।
আবার, কোরবানির ঈদ মানেই ঘরে ঘরে মাংসের নানা পদের আয়োজন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী আর সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ- সকলের পাতেই এদিন মাংস ওঠে। স্বাদে গন্ধে ম ম করে সকলের ঘর-দুয়ার। সেই ঘ্রাণ আর স্বাদ তথা ফ্লেভারের প্রাণ ভোমরা কিন্তু মসলার মাঝেই লুকিয়ে থাকে।
মাংসের বেসিক কিছু মসলা আছে যেমন আদা, রসুন, পেঁয়াজ। আগে কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলেই বাড়িতে বাড়িতে শিলপাটায় লাগাতার মসলা পেষার শব্দ শোনা যেত। এখন মিকশ্চার-ব্লেন্ডারের ভোঁ-ভোঁ, ঘর ঘর শব্দ সেই জায়গা নিয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে ভালো মানের গুঁড়া মসলাও। হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা আস্ত কিনে নিয়ে গুঁড়া করিয়েও নেয়া যায়।
মাংসে আদা, রসুন, পিঁয়াজের ব্যবহারে আছে বহু রকমফের। মিহি করে বেটে নেয়া আদা-রসুন রেড মিটের যেকোন পদের বেস তৈরি করে, মাংসের রোঁয়াকেও নরম করে। পেঁয়াজবাটা তো কোরমায় লাগবেই, ঝোলের পদেও দেবে মসৃণ গ্রেভি।
কাবাবের ম্যারিনেশনে পানি যত কম তত ভালো, তাই আদা-রসুনও পানি দিয়ে বাটলে ভালো ফল মিলবে না। তবে কোন কোন কাবাব যেমন টার্কিশ শাওয়ারমাতে মাংস নরম করতে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করা হয় ম্যারিনেশন বেস হিসেবে। কাটা মসলার মাংস, যেকোন ওরিয়েন্টাল ডিশে জুলিয়েন কাট বা লম্বা কুচি করা আদা-রসুন ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজকুচি দিয়েই বেশির ভাগ দেশি পদ শুরু হয়। তবে বাদামি করে ভেজে নেয়া বেরেস্তা খুব প্রয়োজন বিরিয়ানি, রেজালাসহ মোগলাই পদগুলোতে। বিহারি কাবাব, চাপ কাবাব, হান্ডি কাবাবে বেরেস্তা বেটে দেয়া হয় মাংসের সঙ্গে। পেঁয়াজের মোটা কুচি শেষে না দিলে দোপেয়াজা তো হবেই না।
সঠিক মিহিত্ব ও পরিমাণের আদা-রসুনবাটা ও পেঁয়াজকুচি আবার কিমা দিয়ে করা কাবাব যেমন জালি কাবাব, মুঠা কাবাব, আদানা কাবাব, শামি কাবাব, চাপলি কাবাব আর গালৌটি কাবাবের টেকশ্চারকে রসালো করে।
হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা আর বিভিন্ন গরমমসলা যেমন এলাচি, দারুচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রী- এগুলো সকলেই কমবেশি ব্যবহার করি আমরা মাংস রান্নায়। এদিকে পায়া বা নেহারির সঠিক ফ্লেভার পেতে দরকার শুকনো আস্ত আদা যাকে বলে সঁওট, দেশের দক্ষিণভাগে মাংসের সঙ্গে ব্যবহার হয় ঝাঁঝালো চুইঝালের মত বিশিষ্ট কিছু মসলা। পাবনা অঞ্চল, চট্টগ্রামসহ অনেক এলাকায় ছোট ধনিয়া বা রাঁধুনি লাগবেই মাংস রান্না করতে। জায়ফল, জয়ত্রী বা লবঙ্গ ব্যবহারে পরিমিতি দরকার খুব। নয়ত তিতকুটে ভাব আসবে। খাসি বা ভেড়ার মাংসে একদম সাধারণ হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা-রসুনের সঙ্গে কয়েকটি লবঙ্গ ফেলে দিলেই স্বর্গীয় সৌরভ আসে। মাংসে সবসময় খুব বেশি মসলা দেওয়ার আসলে দরকার নেই৷
আবার বিরিয়ানি করতে গেলে মসলার প্রস্তুতি নিতেই দিন কাবার। ফলাফলও হয় তেমনি সুবাসিত। জাফরান, শাহি জিরা, মৌরি, তারা মসলা, কাবাবচিনি,পিপুল মরিচ, সাদা গোলমরিচ, কালো এলাচ- প্রতিটির আছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাদ ও গন্ধ দেয়ার ক্ষমতা। হালের ক্রেজ ওরিয়েন্টাল খাবারের সঠিক ফ্লেভার আসে তারামসলা আর সিচুয়ান গোলমরিচের কল্যাণে, টেস্টিং সল্ট নয়। এদিকে আরব, পারস্য আর আফ্রিকান ঘরানার খাবারে অত্যাবশক অলস্পাইস, দারুচিনি, পিপুল মরিচ, লবঙ্গ। স্টেক বানাতে গেলে আবার বেশি মসলা না দেয়াই ভালো। লবণ-গোলমরিচই সই। স্টু বা স্যুপে চলতে পারে তেজপাতা আর শেষে গোলমরিচ বা ক্ষেত্রবিশেষে জায়ফলের গুঁড়া।
মসলা আবার একা এক রকম, নিজের সঠিক সঙ্গীদের সমন্বয়ে আরেক রকম জাদু তৈরি করে। তাইতো আমাদের পাঁচফোড়ন, গরম মসলা, মেজবানি মাংস, রেজালাসহ নানা রকমের মাংসের মসলা মিশ্রণ, বিরিয়ানি মসলা। বংশ পরম্পরায় সযত্নে সংরক্ষিত এই মসলা মিশ্রণগুলো যদি জাদুঘরে রাখা যেত! সারা বিশ্বেই যাতার, রাস এল হানুত, বেরবেরে স্পাইস, ক্যাজুন স্পাইসসহ বহু এমন মসলা মিশ্রণ যুগ যুগ ধরে মাংসের পদের অলংকার হয়ে আছে৷
মসলা এক জাদুই কাঠি। একই জিরার কতরকম ব্যবহার। বেটে মাংস কষানোর সময় দিয়ে দিলে এক রকম ফ্লেভার, শুরুতে ফোড়নে আস্ত দিলে আরেক রকম। একেবারে শেষে মাংস নামানোর আগে টালা জিরার গুঁড়া ছড়িয়ে দিলে সেই ম্যাজিক ডাস্ট আবার আরেক মাত্রা নিয়ে আসে। মসলা-মাংস আসলেই রাজযোটক- বলতেই হয়।