বিশ্ব দুগ্ধ দিবস: বিশ্বের তরল বিস্ময়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঠিক কবে, কত বছর আগে মানুষ প্রথম তৃণভোজী পশুর দুধ দোহন করে নিজেরা পান করতে শুরু করেছে, সে গবেষণা ইতিহাসবিদদের জিম্মায় দিয়েই আজকের দুগ্ধবন্দনা শুরু করা যাক। আজ বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। সারা বছর ধরে বিশ্বের সর্বত্র দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য খাওয়া ও পান করা হচ্ছে আদিকাল থেকেই । তবু এই একটি দিন না হয় তোলা থাক বিশেষভাবে দুধময় উদ্‌যাপনের জন্য। মানুষের জীবনে অত্যন্ত পুষ্টিকর ও উপাদেয় পানীয় হিসেবে দুধ জুড়িহীন।

বিশ্বব্যাপী ছাগল, উট, ভেড়া, মহিষ; এমনকি কোনো কোনো দেশে চমরি গাই বা ঘোড়ার দুধের প্রচলন থাকলেও সাধারণ অর্থে আমরা দুধ বলতে গরুর দুধই বুঝি, যা আসলে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। সেই হাজার হাজার বছর আগে থেকেই পশু পালন ও দুগ্ধ দোহনের প্রচলন রয়েছে পৃথিবীর সব প্রান্তে। তবে দুগ্ধবাহী নানা রোগবালাইয়ের বাধা পেরিয়ে বাণিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদন, নিরাপদ সংরক্ষণ ও সরবরাহ নতুন মাত্রা পায় পাস্তুরীকরণ ও জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার যথাযথ পদ্ধতি মানুষের হাতের নাগালে আসায়।

বিজ্ঞাপন

দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার ও পানীয়

দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যগুলোর আছে বৈচিত্র্য
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যগুলোর আছে বৈচিত্র্য
মডেল: প্রিন্স, মাহেলেকা, ছবি: সাইফুল ইসলাম, লোকেশন: ফুডিস’ স্টেশন, কৃতজ্ঞতা: বাপন রহমান

সারা পৃথিবীতেই দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যগুলোর আছে বৈচিত্র্যময় সব ব্যবহার। এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মানুষ দুধ পান করে না বা দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করে না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, একেক দেশে দুধ ও দুধজাত খাদ্যপণ্যের কদর এক হলেও ব্যবহার অতি বিচিত্র।

বিজ্ঞাপন

দুধ

তরল দুধ
তরল দুধ
ছবি: সাইফুল ইসলাম

প্রথমেই আসে খাঁটি, অকৃত্রিম ও তরল দুধের কথা। আবার ইউএইচটি বা আল্ট্রা হিট ট্রিটেড মিল্ক, ঘনীভূত বা এভাপোরেটেড ও কনডেন্সড মিল্ক বা পাউডার মিল্ক রূপে দুধ পাওয়া যায়। চা বা কফির সঙ্গে ব্যবহারের জন্য সহজে দ্রবণীয় ক্রিমারও মেলে বাজারে। তবে যে রূপেই হোক, বিভিন্ন ডেজার্টের মূল উপাদানই দুধ। দুধের সঙ্গে চালের সমন্বয়ে আমাদের যেমন আছে ক্ষীর, পায়েস, ফিরনি; তেমনি পশ্চিমা ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও রাইস পুডিং করা হয় দুধ দিয়ে। তবে পার্সি, আফগান এবং উপহাদেশীয় দুধ দিয়ে ভার্মিসিলি বা সেমাই দিয়ে রান্না করা ডেজার্ট অন্য কোথাও নেই।

ডেজার্টের মূল উপাদানই দুধ
ডেজার্টের মূল উপাদানই দুধ
মডেল: প্রিন্স, মাহেলেকা ছবি: সাইফুল ইসলাম লোকেশন: ফুডিস’ স্টেশন

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু দেশে আবার সাগু বা টাপিওকার পায়েস জাতীয় খাবার করা হয় দুধ দিয়ে। অঞ্চল ভেদে দুধের এসব মিষ্টান্নে মেশে জাফরান, গোলাপজল, জায়ফল, এলাচ এমনকি পানডান পাতার ফ্লেভারও। দুধের সঙ্গে ডিমের মেলবন্ধনের ডেজার্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমাদৃত হলো কাস্টার্ড ও ক্যারামেল ফ্ল্যান বা আমরা যাকে পুডিং বলি। দুধের সঙ্গে বিভিন্ন ফল, কেক, সেভ, জেলো, ফলের প্রিজার্ভসহ বিভিন্ন পুর ও টপিংয়ের স্তরে সাজানো হয় ফালুদা, ট্রাইফল ইত্যাদি। এ ছাড়া দুধের শরবত, মিল্কশেক, স্মুদি ইত্যাদি তো রয়েছেই।

ক্রিম-মালাই-সর

দুধের ননী দিয়েই তৈরি হয় নানা ধরনের ক্রিম
দুধের ননী দিয়েই তৈরি হয় নানা ধরনের ক্রিম
ছবি: সাইফুল ইসলাম

দুধের ননী অর্থাৎ চর্বিজাতীয় অংশটিকে নানা কায়দায় বের করে ক্রিম, ডবল ক্রিম , হেভি ক্রিম হিসেবে সারা বিশ্বে ব্যবহার করা হয় মিষ্টি-নোনতা-ঝাল সব রকম খাবারেই। এই ক্রিম ফাঁপিয়ে আবার হুইপড ক্রিম বানানো হয়, যা দুনিয়াজুড়ে কেক ও অন্যান্য ডেজার্ট সাজাতে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে দুধ ঘন করে সেই সর দিয়ে সরভাজা আর রাবড়ি হয়। ঘন হয়ে একেবারে মালাই বা ক্ষীরসা হয়ে গেলে তার পুর দিয়ে হয় পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি। সর-মালাই এমনিতেই অতিথি আপ্যায়নে লাবড়ি-মলাই নামে বা তা দিয়ে তৈরি মালাই চা আবার আরেক মাত্রা এনে দেয় ঢাকাইয়া খাদ্যতালিকায়। রেজালা, মুসাম্মান, কোর্মা, মুর্গ মাখনি বা বাটার চিকেন, মালাই কোফতায় এই বিলাসী ক্রিম বা ননী অপরিহার্য। বিভিন্ন ক্রিমি সুপ ও ক্যাসারোলে অত্যাবশ্যকীয় ক্রিম। আর ডেজার্টের আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ক্রিমের প্রাধান্য অত্যন্ত বেশি। আর বিশেষ করে আলাদাভাবে বলতে হয় আইসক্রিমের কথা। জেলাটো, কুলফি বা আমেরিকান স্টাইলের আইসক্রিম ক্রিম ছাড়া সম্ভব নয় বানানো।

মাখন ও ঘি

দুধ থেকেই তৈরি হয় ঘি
দুধ থেকেই তৈরি হয় ঘি
ছবি: উইকিপডিয়া

দুধ থেকেই তৈরি হয় মাখন ও ঘি। মাখন তো ঝাল, মিষ্টি, নোনতা—সব স্বাদের খাবারেই সমান দাপটে উপস্থিত। মাখন না থাকলে পৃথিবীতে কোনো কেক , পেস্ট্রি বা পাই তৈরি হতো না। স্টেক, স্টু, স্যুপ থেকে শুরু করে বাটার চিকেন আর ডালমাখানি, মাখনেরই কারবার সব। আমাদের উপমহাদেশের ক্ল্যারিফায়েড বাটার বা ঘি অবশ্য এক সম্পূর্ণ আলাদা রাজকীয় স্বাদ ও গন্ধ এনে দেয় মোগলাই, আওধি আর পার্সিয়ান প্রভাবে সমৃদ্ধ বিরিয়ানি, রেজালা, মোসাল্লামে। ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ রান্নায়ও ঘি এক অপরিহার্য নাম। ঘিয়ের বাগাড়ে যেকোনো সবজি বা ডালের পদ পায় এক স্বর্গীয় ফ্লেভার। ঘি খাঁটি হলে তা বহু বছরেও স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায় নষ্ট হয় না।

চিজ বা পনির

বিচিত্র সব চিজ ছাড়া পৃথিবীর খাদ্য মানচিত্র অসম্পূর্ণ
বিচিত্র সব চিজ ছাড়া পৃথিবীর খাদ্য মানচিত্র অসম্পূর্ণ
মডেল: প্রিন্স, মাহেলেকা ছবি: সাইফুল ইসলাম লোকেশন: ফুডিস’ স্টেশন
দুই ধরনের চিজ ও মাখন
দুই ধরনের চিজ ও মাখন
ছবি: সাইফুল ইসলাম

বিচিত্র সব চিজ বা পনির ছাড়া পৃথিবীর খাদ্য মানচিত্র অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আছে ইতালির গরগনজোলা, পারমেজান আর মোৎজারেলা, সুইস চিজ এমেন্টাল আর গ্রুইয়ের, ফ্রেঞ্চ চিজ ব্রেই আর ক্যামেমবার্ট, গ্রিক চিজ ফেটা, ব্রিটিশ চিজ চেডার আর আমাদের চিরচেনা ঢাকাই পনির। দুধ ফুটে উঠলে একটু ঠান্ডা করে সেই ঈষদুষ্ণ দুধে এটিকে ফাটানোর জন্য রেনেট বা অম্লীয় কোনো উপাদান দিয়ে চিজ তৈরি হয়। আমাদের ঢাকাই পনির বা অষ্টগ্রাম পনির কটেজ চিজ গোত্রীয়।

ছানা

ছানা দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের মিষ্টি
ছানা দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের মিষ্টি
ছবি: সাইফুল ইসলাম

ফুটন্ত দুধে সিরকা বা অম্লীয় উপাদান যোগে ছানা তৈরি করা হয়। দুধের সমস্ত সলিড অংশ আলাদা করে ছেঁকে নিয়ে ছানার পানি বা হুয়েই আবার বিভিন্ন কাজে লাগানো যায়। এই ছানা আমাদের উপমহাদেশের খাদ্যতালিকায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ছানা থেকে সম্পূর্ণরূপে পানি বের করে তা দিয়ে বিভিন্ন নিরামিষ পদ করা হয় উপমহাদেশজুড়েই। একেই আবার পনিরও বলা হয়। ছানার ডালনা, ছানার রসা, পনির টিক্কা, পনির পাসান্দা—ছানার আছে বহুমুখী ব্যবহার। তবে ছানা থেকে তৈরি সন্দেশ, রসগোল্লা, রসমালাই, সীতাভোগ, ছানামুখী, রাজভোগ, কাঁচাগোল্লা, চমচম, গোলাপজাম, কালোজামের কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। ছানার মতো করেই দুধ ফাটিয়ে নিয়ে আবার বানানো হয় কালাকান্দ মিষ্টি।

দই

সারা বিশ্বেই প্রচুর পরিমাণে দই খাওয়া হয়ে থাকে
সারা বিশ্বেই প্রচুর পরিমাণে দই খাওয়া হয়ে থাকে
ছবি: সাইফুল ইসলাম

সারা বিশ্বেই প্রচুর পরিমাণে দই খেয়ে থাকে সবাই। হজমি গুণের জন্য যেমন শেষ পাতে দই না হলে চলে না, আবার ফলাহার বা ইফতারে সহজপাচ্য দই আবশ্যক। ভারত ও পাকিস্তানে দই ছাড়া খেতেই বসেন না অনেকে, তা সঙ্গে ভাত, রুটি, নান, পরোটা, কুলচা যা-ই খাওয়া হোক না কেন। দই দিয়ে যেমন হয় দইবড়া, রায়তা, লাচ্ছি, শ্রীখান্ড, বোরহানি ইত্যাদি; তেমনি রান্নার উপকরণ হিসেবে দইমাছ, রেজালা, বিরিয়ানি, কাবাব ইত্যাদি পদে অপরিহার্য দই।

খোয়া বা মাওয়া

দুধ একেবারে ঘন করে মাওয়া বা খোয়া তৈরি হয়। এই মাওয়া হালুয়া, বরফি, জর্দা, লাড্ডু, ক্ষীরসহ বিভিন্ন মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হয়। দেওয়া হয় মোগলাই আর আওধি খাবারে। আবার পেড়া জাতীয় মিষ্টি আসলে দুধ দিয়ে বানানো খোয়া বা মাওয়াই। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এর বিশেষ কদর রয়েছে।

খোয়া
খোয়া
ছবি: উইকিপিডিয়া

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস মানেই সুস্বাস্থ্যের জন্য দুধের উপকারিতাগুলো আবারও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নেওয়া। আর সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে সব মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ও পানীয়ের স্বাদ নিয়ে উদ্‌যাপনের দিনও আজ। শুভ্র এই জাদুদ্রবণ আমাদের জীবনে এর জাদু ছড়িয়ে দিক সুস্বাস্থ্য, সুখ আর সমৃদ্ধিরূপে।

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ০৮: ৪৪
বিজ্ঞাপন