তুরস্কের ৫ পদ: বেড়াতে গেলে অবশ্যই চেখে দেখতে ভুলবেন না ২
শেয়ার করুন
ফলো করুন

তুর্কি রান্নাঘর পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ রন্ধন ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে, যেমন চীনা, ভারতীয় বা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি তুর্কি খাবারের রেস্তোরাঁও বিভিন্ন স্থানে সৌরভ ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে তুর্কি খাবারের প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উত্তপ্ত কয়লার আঁচে শিকে গাঁথা নানা রকম কাবাব ও ডোনারের মোহনীয় ছবি।

তুরস্কের খাদ্যসংস্কৃতি  বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ
তুরস্কের খাদ্যসংস্কৃতি বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ

অথচ তুরস্কের প্রতিটি অঞ্চল নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতি বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। এখানে এমন পাঁচটি পদ নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলোর সঙ্গে পরিচয় বাইরের দুনিয়ায় হয়তো সেভাবে নেই। অথচ তুরস্ক ভ্রমণে এই পঞ্চপদ না খেলে জীবন বোধকরি ষোলোআনাই মিছে হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।

বিজ্ঞাপন

কোকোরেচ

তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীন শহর বুরসার পথে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হয় কোকোরেচ নামের এক অদ্ভুত ও রহস্যময় খাদ্যের সঙ্গে। আমার তুর্কি বন্ধু সামেতই আমাকে কোকোরেচের স্বাদ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কোকোরেচ তুরস্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মুখরোচক খাদ্য, যা তার মূল্য ও স্বাদের ঝাঁজে সবার মন জয় করে। খাবারটি শুধু তুরস্কের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় স্থান করে নেয়নি, বরং এর তীব্র মসলাদার স্বাদও এটিকে এক অপূর্ব স্বকীয়তা দান করেছে। সে সময় যখন ৫ থেকে ৭ লিরায় ডোনারের স্বাদ নেওয়া যেত, তখন কোকোরেচের একটি ছোট্ট অংশের মূল্য উঠত ১৫ থেকে ২৫ লিরা।

এভাবেও স্বাদ নেওয়া যেতে পারে
এভাবেও স্বাদ নেওয়া যেতে পারে

২০১৯ সালের সেই স্মৃতি আজও সজীব। সামেতের কথা শুনে আমাদের মানে আমি ও আমার দুই প্রবাসী বাংলাদেশি সঙ্গী—মেহেদি ভাই ও আশিক ভাইয়ের চোখ যেন বিস্ময়ে কপালে উঠে গেল। তাঁদের মুখমণ্ডলে অস্বস্তির একটি ছায়া পড়ল, ফুটে উঠল অপ্রত্যাশিত এক অভিব্যক্তি। মেহেদি ভাই তুর্কি ভাষায় সামেতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমার মা বাড়িতে পরম যত্নে গরুর মাংস রাঁধেন, সেই স্বাদের কাছে আমার হৃদয় আবদ্ধ। আর এখন আমি কী খাব? পশুর ফেলে দেওয়া কোনো অংশ থেকে তৈরি এমন খাবার?’ তাঁর কণ্ঠে ছিল বিস্ময়মিশ্রিত এক আশঙ্কা। তবু কোকোরেচের সেই রহস্যময় স্বাদ আমার কৌতূহল জাগিয়ে তোলে।

বিজ্ঞাপন

সত্যি বলতে, কোকোরেচের উপাদান শুনলে অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে। এই খাবার তৈরি হয় ভেড়া কিংবা ছাগলের অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইন দিয়ে। কোকোরেচে মিশে থাকে চর্বির সূক্ষ্ম পরত, যা তাকে কিছুটা ভারী করে তোলে। আমাদের দেশে পশু জবাইয়ের পর তার অন্ত্র বা নাড়ি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়ে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত হয়। এগুলো আমাদের দৃষ্টিতে মূল্যহীন, নগণ্য বর্জ্যমাত্র। এ কারণেই কোকোরেচ নামের খাদ্যটি অনেকের রুচিতে বাধতে পারে। তা ছাড়া কোকোরেচের মধ্যে নিজস্ব একটা গন্ধ আছে, যা কখনো কখনো তীক্ষ্ণ ও অসহ্য ঠেকে। ফলে কারও কারও বমি আসতে পারে। তবু এই গন্ধ ও স্বাদের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে এক অপরিচিত রসনার আমন্ত্রণ, যা সাহসীদের জন্য হতে পারে আবিষ্কার।

সাধারণত ব্রেডের মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করা হয়
সাধারণত ব্রেডের মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করা হয়

কোকোরেচ প্রস্তুতের প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে এক নিপুণ কাব্য—জটিলতা অথচ শৈল্পিক। প্রথমেই অন্ত্রগুলো যত্নসহকারে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করা হয়, যাতে কোনো ময়লা না থাকে। তারপর থাইম, লাল মরিচ ও লবণের মতো মসলায় মাখিয়ে, শিকে কিংবা গ্রিলে গেঁথে আগুনে ঝলসানো হয়। আগুনের স্পর্শে কোকোরেচের স্বাদ জেগে ওঠে। সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। রান্না শেষে এটিকে সূক্ষ্মভাবে কেটে ছোট ছোট খণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর আসে স্বাদের আরেক স্তর—গ্রিলে পোড়ানো টমেটো, পেঁয়াজ ও মরিচের মতো সবজির সঙ্গে পার্সলির মিশিয়ে সদ্য সেঁকা গরম রুটির ফাঁকে কোকোরেচ পুড়ে স্যান্ডউইচের রূপ দেওয়া হয়। মুখে দিলে স্বাদের উদ্বেল হয়ে ওঠে স্বাদকোরক। তবে অন্যতর স্বাদ নিতে চাইলে কোকোরেচকে স্বতন্ত্র পদ হিসেবেও উপভোগ করা যেতে পারে।

তুরস্কের ইজমির ও দেনিজলি শহর কোকোরেচের স্বর্গরাজ্য। ইস্তাম্বুল, ইজমির কিংবা বুরসার রাজপথে পা রাখলে চোখে পড়বে রেস্তোরাঁর সামনে শিকে বা গ্রিলে গাঁথা কোকোরেচ, আগুনের আঁচে সেঁকা হচ্ছে আর চারপাশ উন্মাতাল হয়ে উঠছে এর মাদকীয় ঘ্রাণে।

আমাদের দেশের অনেকেই কোকোরেচ নিয়ে দ্বিধান্বিত হতে পারেন। তবে সাহস করে চেখে দেখলে হতাশ হবেন না। কোকোরেচ কেবল কোনো পদ নয়, এ এক স্বাদের কাব্য, যা জিবে লেগে থাকে বহুদিন।
ছবি: লেখক ও পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ০০
বিজ্ঞাপন