মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে নেমে স্থানীয় বড় মসজিদের কথা বললেই এলাকার মানুষ দেখিয়ে দেবে জায়গাটা। বড় মসজিদের ঠিক পেছনেই এই চাপের দোকান। আশপাশে আরও চাপের দোকান থাকলেও বেশ পুরোনো আর এর অতুলনীয় স্বাদ বেশির ভাগ মানুষকে টেনে আনে এখানেই।
ছোট্ট দোতলা দোকান। নিচতলায় লাকড়ির চুলার ওপর তাওয়ায় ছাড়া হচ্ছে গরু, খাসি বা মুরগির চাপ আর ওপরের তলায় আয়েশ করে সবাই সেগুলো খাচ্ছেন লুচি দিয়ে। সাধারণত বিকেল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানটি। মূলত সন্ধ্যা থেকেই বাড়তে থাকে ভিড়। কখনো কখনো বেশি ভিড়ের কারণে অর্ডার বুঝিয়ে দিতে দেরি করলে কাস্টমার নিজেই নিচে নেমে যাঁর যাঁর খাবার নিয়ে খেতে থাকেন। এ যেন নিজের দোকান। কারণ, ক্রেতা আর বিক্রেতা উভয় পক্ষই জানেন এখানে সততা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই।
স্বাদের তুলনায় দাম মোটেও বাড়তি মনে হবে না। এক প্লেট গরু বা মুরগির চাপ এখানে পাওয়া যাবে ১৪০-১৫০ টাকার মধ্যে। গরুর মগজের দামও এ রকমই। আর লুচি প্রতি পিস ৫ টাকা। লাকড়ির চুলায় তৈরি হওয়ায় এখানকার খাবারের স্বাদ একেবারেই আলাদা।
আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো। বছর দুয়েক আগেও দোকানটির কাঠামো অন্য রকম ছিল। পুরোটাই ছিল একতলার মধ্যে। এক পাশে লাকড়ির চুলায় তখন ভাজা হতো মজার সব খাবার। আর পাশেই ছিল টেবিল-চেয়ার। হ্যাঁ, ওপরে কোনো ছাদ বা শামিয়ানা ছিল না। খোলা আকাশের নিচে মাথার ওপর চাঁদ রেখে আয়েশ করে চাপ আর লুচি খাওয়া, সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! রাস্তা সংস্কারের কাজ করায় সেই পরিবেশ আর নেই। এখন দোতলা দোকান। তবে স্বাদে এতটুকু প্রভাব পড়েনি এই পরিবর্তনে।
শুধু চাপের কথাই বলছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু গরু, খাসি বা মুরগির চাপ ছাড়াও গরুর বট, মগজ, তিললি, খিরির চাহিদাও কম নয়। সঙ্গে তেঁতুলের টক দেওয়া সালাদ যে কারও জিবে জল আনার জন্য যথেষ্ট। তাঁরাও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন মেনুতে নতুন কিছু যোগ করতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এত রকম খাবারের ভিড়ে চাপের চাপই বেশি সামলাতে হয় তাঁদের।
নব্বইয়ের দশকে কাল্লুর কাবাবের সঙ্গে আমার পরিচয়। যদিও তাঁদের এই ব্যবসা বেশ পুরোনো। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাঁরা ব্যবসা করে আসছেন। কাল্লুর কাবাব এখন তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। বর্তমানে ব্যবসা সামলাচ্ছেন আরিফ হোসেন। তিনিই সাব্বির হোসেন বা কাল্লুর ছেলে। কাল্লু মিয়া এটা পেয়েছেন পৈতৃক সূত্রে। নিজেই একসময় চাপ তৈরি করতেন। বিকেল হলেই লাকড়ির চুলার পাশেই বসে যেতে দেখতাম তাঁকে। যত্নের সঙ্গে তাওয়ার ওপর ফুটন্ত তেলে চিকন করে কাটা মাংসের একেকটা টুকরা উল্টেপাল্টে বছরের পর বছর তৈরি করে গেছেন মুখরোচক সব চাপ।
কেবল রান্না নয়, ব্যবসা পরিচালনাতে কাল্লু মিয়া ছিলেন দক্ষ। তবে বয়স আর অসুস্থতা মিলিয়ে তিনি এখন আর দোকানে বসেন না। তাঁর ছেলেই করছেন পুরো ব্যবসার তদারক। শুধু সাব্বির হোসেন নন, দোকানে আজ অবধি যত কর্মচারীকে কাজ করতে দেখেছি, তাঁদের সবার ব্যবহার যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কোনো রকম বিরক্তি ছাড়াই তাঁরা চেষ্টা করেন কাস্টমারকে যথাসম্ভব সন্তুষ্ট করতে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই দোকানের নিয়মিতরা এখানে আসছেন সেই কিশোর বয়স থেকেই। তখন হয়তো একা বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসতেন। আর এখন আসেন সপরিবার। ফলে ব্যবসা যেমন প্রজন্মবদল হয়েছে, তেমনি খদ্দেরদের মধ্যেও। এই ট্রানজিশনই বলে দেয়, ‘ব্র্যান্ড লয়ালটি’ কাকে বলে!
ছবি: লেখক