কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস পা দিয়েছে চতুর্দশ বছরে। এ সময়ের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে সারা ইউরোপে। এটাই বলা যেতে পারে ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানজনক কারি অ্যাওয়ার্ড। কারি লাইফ ইভেন্টসের আয়োজনে প্রতিবছর লন্ডনে বিখ্যাত কোনো হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় এই আসর।
গত রোববার সেন্ট্রাল লন্ডনের অভিজাত লন্ডন ম্যারিয়ট হোটেলের সুপরিসর ওয়েস্টমিনস্টার বলরুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের আসর। এ বছরেরে কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস ও গালা ডিনার ২০২৩–এ পাঁচটি বিভাগে মোট ৪৪টি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ছিল কারি লাইফ এডিটরস চয়েস রেস্টুরেন্টস অ্যাওয়ার্ডস, কারি লাইফ বেস্ট রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ডস, কারি লাইফ বেস্ট শেফ অব দ্য ইয়ার, বেস্ট টেকওয়ে অব দ্য ইয়ার ও কারি লাইফ রিকমেন্ডেড রেস্টুরেন্ট ২০২৩।
কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস ও গালা ডিনারের এটা ছিল ১৪তম আয়োজন। কারি ইন্ডাস্ট্রির অর্জন, সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে নিয়মিত প্রকাশনা ও বিভিন্ন দেশে ‘ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজনের মাধ্যমে কারি লাইফ ইতিমধ্যে ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মুখপত্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের কালিনারি ক্যালেন্ডারের অন্যতম সেরা আয়োজন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস।
যুক্তরাজ্যে কারি ইন্ডাস্ট্রির সম্মানজনক এই সম্মাননা অনুষ্ঠানে এবারও রেস্টুরেটার্স ও খাদ্যরসিকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। পাঁচ শতাধিক অতিথির উপস্থিতিতে সরগরম ছিল অনুষ্ঠানস্থল। উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিরা। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন কারি ইন্ডাষ্ট্রির শীর্ষস্থানীয় নেতারা, রেস্টুরেন্ট মালিক ও শেফরা।
বৈচিত্র্যময় ও সুস্বাদু ক্যানোপির সঙ্গে চলে অতিথিদের ছবি তোলা ও আড্ডা।
মূল আয়োজন শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় চার বিলিয়ন পাউন্ডের অবদান রাখে কারি ইন্ডাষ্ট্রি। বিশাল এই রেস্টুরেন্ট সেক্টরের সেরাদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাষ্ট্রিজের (সিবিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট, হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড করণ বিলিমোরিয়া। লন্ডনবিষয়ক উপমন্ত্রী ও টেক অ্যান্ড ডিজিটাল ইকোনমি–বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি পল স্কালি এমপি।
ওয়ার্থিং ওয়েস্টের এমপি ফাদার অব দ্য হাউস অব কমন্স স্যার পিটার বটমলি, সেন্ট অস্টেল অ্যান্ড নিউ কি আসনের এমপি, জুনিয়র লর্ড কমিশনার স্টিভ ডাবল এবং শ্যাডো ইনভেস্টমেন্ট ও স্মল বিজনেস মন্ত্রী, বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের এমপি রুশনারা আলী। স্যার বটমলি ও ষ্টিভ ডাবল এমপি তাদের এলাকার দুটি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ব্যবসাকে সমর্থন জানানোর জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। যুক্তরাজ্যের টিভি আইটিভির সংবাদপাঠক লুকরেসিয়া মিলারিনির উপস্থাপনায় উপভোগ্য হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান।
এবারের আয়োজন ছিল নতুনত্বে ভরা। নজরকাড়া সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি ছিল সুস্বাদু নানা পদের খাবার। অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের মঞ্চে নেওয়া হয় বিশেষ মর্যাদায়। আবার পুরো অনুষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়
এবারের আয়োজনে টাইটেল স্পন্সর ছিল গ্রাহকের কাছে রেস্টুরেন্টের খাবার পৌঁছে দেওয়ার সেবা প্রদানকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ‘জাস্ট ইট’। আরও সহযোগিতায় ছিল ইউনিসফট, ওয়ার্ক পারমিট ক্লাউড, কোবরা বিয়ার ও ট্রেভেল লিংক।
অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘কারি লাইফ’ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশার সূচনা বক্তব্যে। কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডসের ১৪তম আয়োজনটি একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর কারি লাইফ ম্যাগাজিন প্রকাশনার ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর ভাই সৈয়দ বেলাল আহমদ ১৯৭০ দশকে যুক্তরাজ্যে আসার পর কারির প্রতি ব্রিটিশদের আগ্রহের মাত্রা দেখে অবাক হয়েছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে কারির এই নতুন আবাস খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিকে তাঁরা উদ্যাপন ও সামনে এগিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ২০ বছর আগে কারি লাইফ ম্যাগাজিন শুরু করেন। এরপর ২০০৯ সালে শুরু করেন কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস। তিনি বলেন, এখন ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ব্রিটিশ কারির কদর করেন। কারণ, ব্রিটিশ কারি একটি স্বতন্ত্র স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে এবং এর বৈচিত্র্য অব্যাহতভাবে বিকশিত হচ্ছে।
রেস্টুরেন্ট সেক্টরের নানা চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে সৈয়দ নাহাস পাশা বলেন, রেস্টুরেন্ট সেক্টরের ন্যায্য দাবির পক্ষে কারি লাইফ টিম অব্যাহতভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাবে।
করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে শুরু হয় মূল্যস্ফীতির চাপ। এর ওপর আছে কর্মী–সংকট। কিন্তু এত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের কারি সেক্টর, বলেছেন কোবরা বিয়ারের স্বত্বাধিকারী লর্ড করণ বিলিমোরিয়া।
রেস্টুরেন্ট পরিচালনা কেবল একটি ব্যবসা নয়, এটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাহন। আবার অনেকের কাছে এটি পারিবারিক ঐতিহ্য বলেও অভিমত ব্যক্ত করে রেন্টুরেন্টগুলোর বিজনেস রেট কমানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
লর্ড বিলিমোরিয়া মনে করেন, ব্রিটেনের অর্থনীতি ষষ্ট অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভব ছিল না অভিবাসী বাঙালিদের অবদান ছাড়া। এ জন্য তিনি ইমিগ্রেশনের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। রেস্টুরেন্ট ও হসপিটালিটি সেক্টরসহ দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মী–সংকটের দিকে নজর দেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রির মুখপত্র হিসেবে কারি লাইফ ম্যাগাজিনের বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করে করণ বিলিমোরিয়া বলেন, তাদের কল্যাণে এখন ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে। ব্রিটিশ কারির বৈচিত্র্যের কথা প্রশংসনীয়ভাবে তারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন। গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে কারি লাইফ টিমের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করে বিলিমোরিয়া বলেন, নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
লন্ডনবিষয়ক উপমন্ত্রী এবং টেক ও ডিজিটাল ইকোনমি–বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি পল স্কালি এমপি বলেন, হসপিটালিটি–বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য কোভিডকালে হসপিটালিটি কাউন্সিল চালু করা হয়। এখন সরকার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও এর প্রতিনিধিদের নিয়ে একসঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা হয়। এটাই এগিয়ে যাওয়ার উপায়। পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সম্ভব হবে আমাদের অগ্রযাত্রা। তবে ইন্ডাষ্ট্রির উদ্বেগের বিষয়গুলো সরকারকে অবগত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
মূল্যস্ফীতিসহ জীবিকা নির্বাহের এই কঠিন সময়ে রেস্টুরেন্টগুলো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাই ‘জাস্ট ইট’ রেস্টুরেন্ট সেক্টরের বিজনেস রেট অন্তত কয়েক বছরের জন্য ফ্রিজ রাখতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানের প্রধান স্পন্সর ‘জাস্ট ইট’–এর প্রতিনিধি মাট হপার।
ছবি: কারি লাইফ ইভেন্টস