জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, কোনো জাতিকে জানতে হলে, জানতে হবে তারা কী খায় এবং কী বই পড়ে! খাবারের সঙ্গে মিশে থাকে একটি জাতির আবেগ-অনুভূতি ও ইতিহাস। ভোজনরসিক বাঙালি বলে একটা কথা আছে। খাবারের ব্যাপারে বাঙালির একটা দুর্বলতা আছে। তারা খেতে ভালোবাসে, খাওয়াতেও ভালোবাসে। সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর খাবারের নিজস্ব পদ ও খাবার তৈরির ধরন থাকে। সেগুলো একইভাবে বয়ে চলে না।
এক দেশ থেকে অন্য দেশের কিংবা এক শহর থেকে অন্য শহরের খাবারদাবার আর খাদ্যাভ্যাসে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদেরও এমন কিছু নিজস্ব খাবার ছিল বা আছে। তবে নানা সময় নানা জাতির আগমনে তাদের নিয়ে আসা খাদ্য উপকরণ ও রন্ধনশৈলীর সঙ্গে আমাদের খাবার ও তৈরির উপকরণ মিলে বৈচিত্র্যময় অথচ সুস্বাদু খাবার আমরা এখন পাই। সে কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে পূজার প্রথাগত খাবারের সঙ্গে ফিউশন খাবারের মিশেলে থালা হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়।
২০১৬ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু খাবার এবং সেসব খাবারের উৎস বা উৎপত্তি এবং রন্ধনপ্রণালি নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় সাদ উর রহমানের ‘ঢাকাই খাবার ও সংস্কৃতি’ শিরোনামে বইটি। ঢাকাই খাবার বইয়ের ‘ঢাকার ধর্মীয় উৎসবের খাবার’ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, পূজার প্রথম পাঁচ দিন হিন্দুরা নিরামিষ খেয়ে থাকেন। প্রসাদ হিসেবে নিরামিষ, সবজিসহযোগে ভুনা খিচুড়ি, সাদা পোলাও, আমিত্তি, সন্দেশ, লাড্ডু খাওয়া হয়। আর বিজয়াদশমীর দিনে অতিথিদের সাদা আঁশের বড় মাছ, যেমন রুই মাছের ঝোল, ভাত, পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
এদিন লাড্ডু আর জিলাপি একজন আরেকজনের বাড়িতে বিলিয়ে থাকেন। রুই মাছ বা পাঙাশ মাছের কোরমা, ভুনা বা ঝোল তরকারি খাওয়ানোর প্রচলন আছে বিজয়াদশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর। তার আগে পাঁচ দিন কেবল নিরামিষই খেতে হবে শাস্ত্রমতে। মন্দিরেরও দশমী শেষে যে অন্নপ্রসাদ বা ভোগ, কোনোটাতেই আমিষ থাকে না। তবে কেউ যদি আমিষ খেতে চান, তবে বাড়ির আয়োজনে, অতিথি আপ্যায়নে আমিষ থাকে। পাঁঠার মাংসের ঝোল বা মাটন কষা দশমীর দিন অনেকেই বাড়িতে রেঁধে থাকেন।
আমি নিজেই একবার নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলাম পূজার সময়। সকালের সিঁদুর খেলা ও দুপুরবেলা দর্পণ বিসর্জন শেষে দুপুরের খাবারে পরিবেশন করা হলো মাটন কষা। রাঁধুনি পৃথুলা গোস্বামী কলকাতার শ্যামবাজার নিবাসী। মাটন কষা তিনিই রেঁধেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, বিজয়ার দিন তাঁদের ওখানে পাঁঠার মাংসের ঝোল ও মাটন কষা পূজায় খাওয়ার প্রচলন আছে। তিনি জানান, কলকাতায় শ্যামবাজারের গোলবাড়ীর কষা মাংস বিখ্যাত। ভুনা বা কষা, পদ্ধতিগতভাবে অনেকটাই এক। দুটিতেই মাংসকে হালকা আঁচে বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করতে হয়।
এতে একটা খুব সুন্দর, তেল-মসলায় ভরপুর আর দারুণ সুগন্ধযুক্ত গাঢ় বাদামি রঙের ঝোল হয়। সঙ্গে থাকে সুসিদ্ধ নরম তুলতুলে মাংসের টুকরা, যা মুখে দিলেই গলে যায়। পরোটা, লুচি, পোলাও, এমনকি শুধু সাদা ভাত—সবকিছুর সঙ্গেই দারুণ লাগে খেতে।
আমিষে মাছের ক্ষেত্রে রুই-পাঙাশের কথা বললাম। তবে দুর্গাপূজা হলেই ইলিশ নিয়ে শুরু হয়ে যায় মহাযজ্ঞ। এই দেখুন না, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এবারের পূজায় ইলিশ ওপারে যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে কত তর্কবিতর্ক হলো। ইলিশ নিয়ে যে রাজনীতিই হোক না কেন, অবশেষে জয় হলো ধর্মীয় সম্প্রীতির।
ইলিশ দুর্গাপূজায় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, বাংলার ধর্মীয় ও লোকসাংস্কৃতিক উৎসবে ইলিশের আগমন হাজার বছর আগে। বাঙালি হিন্দু পরিবার সরস্বতী, লক্ষ্মী ও দুর্গাপূজায় জোড়া ইলিশ কেনাকে অতি শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখে। তাঁরা এসব পূজায় দেবীকে জোড়া ইলিশ উৎসর্গ করেন। অনেকে আবার রান্না ইলিশে ভোগ দিয়ে থাকেন।
লেখক আলপনা ঘোষ ‘ভোজনবিলাসে কলকাতা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কলকাতার উল্লেখযোগ্য প্রাচীনতম দুর্গাপূজার মধ্যে একটি ১০৮২ সালে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় আগরপাড়ায় মাটির ঠাকুরদালানে চালু হয়। এ ছাড়া ৫৫০ বছরের অধিক কাল আগে নদীয়া জেলার চাঁদনিবাড়ীতে এবং ১৬৬২ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরের জঙ্গিপুরের ঘোষালবাড়ীতে শুরু হয় আরও দুটি প্রাচীন দুর্গোৎসব। এসব উৎসবে দশমীতে পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছের ভোগ দেওয়ার রীতি উল্লেখ রয়েছে। দশমীর আগের রাতে ইলিশ মাছ রান্না করে সকাল সকাল দেবীকে ভোগ দিয়ে তারপর বাড়ির মেয়েরা উপাস ভাঙত। সেই রেশ ধরেই বলা যায়, ইলিশ দুর্গাপূজার ঐতিহ্যের একটি অংশ।
দুর্গাপূজা বা যেকোনো পূজায় নিরামিষ অত্যাবশ্যকীয়। পুরান ঢাকায় শাঁখারীবাজারের ‘জগন্নাথ ভোজনালয়’ নিরামিষ খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। সেখানে গিয়ে কথা হয় স্বত্বাধিকারী অশোক কবিরাজের সঙ্গে। তিনি জানান, ভোজনালয়ের বয়স এখন ১৯ চলছে। দেড় যুগ আগে ২০০৫ সালে নিতাই পাল শুরু করেন এই ভোজনালয়। এখানে সবচেয়ে পুরোনো নিরামিষ ভোজনালয়টি বিষ্ণুপ্রিয়া। তারপরই হয়েছে জগন্নাথ। ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে লোকান্তরিত হন নিতাই পাল। তারপর মালিকানার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এর তত্ত্বাবধানে আছেন অশোক কবিরাজ। গোপীনাথ ভোজনালয়েরও তিনি স্বত্বাধিকারী। জানালেন, জগন্নাথ ভোজনালয়ের সব পদই নিরামিষ। ভর্তা, ডাল, ছানা, বড়া, সয়াবিন, রসা, ধোকা। শেষ পাতে পায়েস আর চাটনি।
রান্নায় পেঁয়াজ ও রসুন ব্যবহার করা হয় না। তবে অন্যান্য মসলা দেওয়া হয়। একাদশীর সময় হলে, চন্দ্রতিথিতে বিশেষ খাবার পাওয়া যায়। পুষ্পান্ন (অর্থাৎ পোলাও), খিচুড়ি, সাবুদানা ভুনা, ছানার রসা, ফুলকপির রসা, পাঁচমিশালি সবজি ও শ্যামা দানার পায়েস করা হয়। একাদশীর রান্না হয় সূর্যমুখীর তেলে। অন্যান্য দিন সয়াবিন ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া পেঁয়াজ-রসুন তো বাদই, অন্যান্য মসলাও একাদশীর রান্নায় দেওয়া হয় না। শুধু আদা আর কাঁচা মরিচ দেওয়া হয়। অশোক কবিরাজ জানান, পূজার সময় এখানে খুবই ভিড় হয়।
দুর্গাপূজার সময়ই একই রকম খাদ্যতালিকায় থাকে অন্ন, লাউ সবজি, লাউশাক, সয়াবিন রসা, পুঁইশাক, বড়ার রসা, কলমিশাক, ফুলকপির রসা, শর্ষেশাক, আলু-বেগুন রসা, পাটশাক, আলুর রসা, কচুশাক, কাঁচা কলার রসা, আলু–করলা ভাজি, বাঁধাকপি, আলু–কচু ভাজি, পাঁচ তরকারি, শজনে তরকারি, আলু–কাঁকরোল ভাজি, মুগডাল, এঁচড়ের তরকারি, পাতলা ডাল, শর্ষে ভেন্ডি, বুটের ডাল, পটোল শর্ষে, মাষকলাই ডাল, আলু–পটোল, লাউ মুগ, চাটনি, কলার মোচা, পায়েস, শুক্ত, শুকনা ভাজা, সাবুর পোলাও, আলুর দম, সাবুর পোলাও হাফ, বাদাম ভুনা, সাবুর খিচুড়ি, শসার তরকারি, আলুভাজা, সাবুর পায়েস, ফুলকপি, চাটনি, পাঁচ তরকারি ইত্যাদি। পূজা উপলক্ষে পলান্ন বা পোলাও, বাসন্তী পোলাওয়ের আয়োজন থাকে।
ঢাকার সুপ্রাচীন মন্দিরগুলোর পূজারি ও সেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোগে সবজি-খিচুড়িই মুখ্য। সঙ্গে পায়েস থাকে মন্দিরভেদে। রামকৃষ্ণ মিশনে খিচুড়ি-পায়েসের সঙ্গে চাটনিও থাকে। মায়ের প্রসাদে ফল থাকবেই। মিষ্টি-টক মিলিয়ে পাঁচ ধরনের ফল রাখার নিয়ম রয়েছে।
পারমিতা মজুমদার ঘোষ জানান, বাড়িতে মিষ্টান্নর মধ্যে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, তালের পিঠা, ছানার পায়েস, বাদাম-চিড়ার নাড়ু ইত্যাদি আয়োজন থাকে। লুচি-লাবড়া এমনিতেই ছুটির দিনে নিত্য আয়োজন করা হয়। তবে পূজার সময় বাড়িতে আসা অতিথি আপ্যায়নে লুচি, লাবড়া, পায়েস ও নাড়ু রাখা হয়।
ছবি: হোটেল আমারি