এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আপনি আমাদের গোপনীয়তা নীতি তে সম্মতি দিয়েছেন
যে কারণে আমাদের দেশের ইস্টার সানডের ভোজ সবার চেয়ে আলাদা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আজ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ উৎসব ইস্টার সানডে। বাংলায় বলা হয় পুনরুত্থান পার্বণ বা পুনরুত্থান রবিবার। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা এই দিনটিকে ঘিরে আনন্দ আয়োজনে মেতে ওঠেন প্রতি ঘরে ঘরে। ইস্টার সানডের আগে খ্রিস্টানরা অনেকেই  ৪০ দিনব্যাপী প্রার্থনা ও বার্ষিক উপবাস করে থাকেন । এই সময় অনেকেই নিরামিষ খান বা বিশেষ সংযম পালন করেন। এই উপবাস পর্বটিকে ইংরেজিতে লেন্ট বলা হয়। লেন্টের শেষের সপ্তাহটিকে বলা হয় পবিত্র বা পুণ্য সপ্তাহ। এ সপ্তাহের রবিবারই হলো ইস্টার। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যেএই উৎসবটি পালন করা হলেও এর আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে বাঙালি কায়দায় ইস্টারের ভোজ, যা অন্যান্য দেশের ইস্টারের খাবারের চেয়ে একেবারেই আলাদা। আর সেজন্যই আমার বাড়িতে আয়োজিত এই ইস্টার স্পেশাল ঘরোয়া ভোজের গল্প জানাচ্ছি আজ।

ইস্টার সানডে-তে এমন ঘরোয়া ভোজের আয়োজন করা হয়
ইস্টার সানডে-তে এমন ঘরোয়া ভোজের আয়োজন করা হয়
এদিন বাঙালি খাবারই খাওয়া হয়
এদিন বাঙালি খাবারই খাওয়া হয়

কেক-কুকিজ নয় বরং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে এমন সব খাবারই ইস্টার সানডেতে খেয়ে থাকি আমরা। কী কী খাওয়া হয় এই দিনে? শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন। ইস্টার সানডের সকালে দই-চিড়া খাওয়ার রীতি বহু বছরের পুরোনো। কিন্তু ঠিক কত বছর তা, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। এই রীতি কোনো নির্দিষ্ট বাইবেলীয় অনুশাসন নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা লোকায়ত খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ।

বিজ্ঞাপন

ধারনা করা হয়, চৈত্র সংক্রান্তি আর বৈশাখ মাসের খুব কাছাকাছি সময়ে এই উৎসব পড়েছে বলে গরমে পেট ঠাণ্ডা রাখতে বহু আগে থেকেই এ সময় দই চিড়া খাওয়ার নিয়ম চালু হয়। শুধু দই চিড়াই নয়, এর সঙ্গে মুড়ি, মুড়কি, গুড়, জবের ছাতু, দুধ, কলা, খই, নানা ধরনের মিষ্টিও আছে এই তালিকায়।

মূল উপকরণ দই-চিড়া
মূল উপকরণ দই-চিড়া
মুড়ি, মুড়কি, গুড়, জবের ছাতু, দুধ, কলা, খই, নানা ধরনের মিষ্টি থাকে সঙ্গে
মুড়ি, মুড়কি, গুড়, জবের ছাতু, দুধ, কলা, খই, নানা ধরনের মিষ্টি থাকে সঙ্গে

গীর্জায় ইস্টার সানডের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাড়ি ফিরে দই-চিড়ার এই বিশেষ থালি দিয়েই উৎসবের শুরু হয়। প্রতি ঘরে ঘরে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক এই ইস্টারের থালি থাকবেই।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার যীশুর মৃত্যুদিন থেকে শুরু করে শনিবার নিরামিষ খাওয়ার চল আছে খ্রিষ্টান বাড়িগুলোয়। তিনদিনের মাথায় অর্থাৎ রবিবারে প্রথম খাওয়া হয় এই ঐতিহ্যবাহী দই-চিড়া থালি । এরপর মাছ-মাংসের পদগুলি দিয়ে নিরামিষ খাওয়ার অবসান হয় দুপুরের খাবারে।

রবিবারে প্রথম খাওয়া হয় এই ঐতিহ্যবাহী দই-চিড়া থালি
রবিবারে প্রথম খাওয়া হয় এই ঐতিহ্যবাহী দই-চিড়া থালি
সঙ্গে কলা থাকে
সঙ্গে কলা থাকে
থাকে নানা পদের মিষ্টি
থাকে নানা পদের মিষ্টি

পশ্চিমা দেশের সঙ্গে কিন্তু এই খাবার রীতির একদমই মিল নেই। বলা হয়ে থাকে, অনেক বাঙালি খ্রিস্টানদের শেকড় গ্রামীণ বাংলায়। সেই প্রেক্ষাপটে দই-চিড়া একদম ঘরোয়া খাবার। তাই এই প্রভাব ও ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে এই দিনের ভোজে।

পছন্দমতো মিষ্টি নেওয়া যায়
পছন্দমতো মিষ্টি নেওয়া যায়

লোকমুখে শোনা যায়, প্রায় ৫০০ বছর আগে পর্তুগীজরা যখন এই বাংলায় ধর্ম প্রচার করতে এসেছিল তাঁরাও এই দই চিড়া খাওয়ার রীতিকে রপ্ত করে নিয়েছিল।

ইষ্টার সানডেতে বাঙালি খ্রিস্টানদের এই আয়োজন উপলক্ষে নানা উপকরণসহ দই চিড়া খাওয়ার বিষয়টি ধর্মীয় আচার, আমিষ থেকে বিরত থাকার উপবাস থেকে একটি বিশেষ খাবারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা আর খাঁটি বাঙালিয়ানা – এই তিনটির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। যদিও একে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বলা যায় না, কিন্তু এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর থেকে গড়ে ওঠা আর সকলের হৃদয়ের কাছাকাছি, স্মৃতিবিজড়িত এক প্রথা।

বেশ আয়োজন করে সাজানো হয় এই থালি
বেশ আয়োজন করে সাজানো হয় এই থালি
গ্রাম-বাংলার প্রিয় খাবার মুড়ি থাকে এই ভোজে
গ্রাম-বাংলার প্রিয় খাবার মুড়ি থাকে এই ভোজে
একই কারণে এই ভোজের অংশ হয়েছে চিড়া
একই কারণে এই ভোজের অংশ হয়েছে চিড়া

প্রাচীন বাংলায় ঘরে ঘরে রেফ্রিজারেটর ছিল না, খাবার সংরক্ষণ করারও উপায় ছিল না সেভাবে। তাই সবদিক থেকেই সহজলভ্য হয় এমন খাবার গ্রহণ করা ছিল একমাত্র উপায়। সেক্ষেত্রে দুধ থেকে দই করে রাখাই বরং বেশি সুবিধার ছিল। আর কৃষিনির্ভর দেশে মুড়ি-চিড়ার মতো শুকনা খাবার ছিল আমাদের রোজকার তালিকায়।  এগুলোই আস্তে আস্তে যোগ হয়েছে ধর্মীয় উৎসবের এই খাবারের রীতিতে। তাছাড়াও, বৈশাখ মাসে প্রাচীনকালে এলাকাভেদে নানা ধরনের মেলা হতো। মেলায় বিক্রি হতো মিষ্টি, বাতাসার মতো সব মুখরোচক খাবারদাবার । সেগুলোও স্থান পেয়েছে বাঙালির ইস্টার সানডের স্পেশাল থালিতে।

পশ্চিমা খ্রিস্টানদের মধ্যে ইস্টার বানি, ইস্টার এগ, ডেভিলড এগ, রোস্ট ল্যাম্ব বা রোস্ট হ্যাম, কুকিজ , কেক, পাউরুটির মতো খাবারগুলো বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বাঙালির সহজাত রুচি আর পটভূমির সঙ্গে এসব খাবার মানানসই ছিল না। ফলে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে ইস্টারে এই দই-চিড়া খাওয়ার সংস্কৃতি।

আমাদের ইস্টারের ভোজ সবার চেয়ে আলাদা
আমাদের ইস্টারের ভোজ সবার চেয়ে আলাদা
মায়াময় স্পর্শে এই সহজ সরল বাঙালি খাবার হয়ে ওঠে বিশেষ
মায়াময় স্পর্শে এই সহজ সরল বাঙালি খাবার হয়ে ওঠে বিশেষ

আমাদের আবহাওয়া আর সংস্কৃতির সঙ্গে যায় এমন খাবারই যুগ যুগ ধরে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে ইস্টার সানডেতে। ধর্মীয় ভাবধারার সঙ্গে সংস্কৃতির এই মেলবন্ধনের কথা হয়তো অনেকেই জানতেন না। এই লেখার মাধ্যমে কিছুটা ধারনা দেওয়া চেষ্টা করেছি তাই। সবাইকে ইস্টার সানডের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬: ৫৫
বিজ্ঞাপন