কেওড়া ফল আমরা অনেকেই চিনি না। কেওড়ার জল আমাদের উপমহাদেশের হেঁশেলে বহুল ব্যবহৃত এক খাদ্যোপযোগী সুগন্ধি উপকরণ। কেওড়ার ফুলের আছে মিষ্টি সুবাস। আর তার নির্যাস দিয়েই এই কেওড়ার জল তৈরি হয়। তবে কেওড়ার ফল খুলনা ও সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও সেভাবে খাওয়ার কথা জানা যায় না। কিন্তু খুলনার মানুষ যুগ যুগ ধরে কেওড়া ফলের দিয়ে ছোট চিংড়ি ও মসুরের ডাল রান্না করে খেয়ে থাকেন।
তবে এ অঞ্চলের ডেলিকেসি বলা যায় কেওড়ার খাট্টাকে। এ ফল এমনিতে টক স্বাদের আর ভিটামিন সিয়ের খনিস্বরূপ। এই খাট্টা রান্না করতে প্রয়োজন যথেষ্ট মুনশিয়ানার। কেওড়ার বিচির তেতো অংশ মিশে গেলেই খাট্টার স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকে এতে গুড় দেন।
আবার কেওড়া ফল দিয়ে আচার আর চাটনিও তৈরি করা হয় আমলকীর মতো করে। এ ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বলা হয়, কেওড়া ফল আমাশয়ও দূর করে। খুলনা অঞ্চলে একটু খোঁজ করলেই পাওয়া যায় এ ফল। এর কারণ এ অঞ্চলজুড়ে এটা দেদার আছে। বনাঞ্চলের হরিণ আর বানরের প্রিয় খাবার কেওড়া। কিন্তু এর পুষ্টিমান এতই বেশি যে কেওড়া খাওয়ার প্রচলন আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আর তা দেশব্যাপী সব অঞ্চলেই।
সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেলের গবেষণা প্রকল্পের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেনের করা গবেষণার ফলাফলসহ প্রকাশিত প্রবন্ধে দেখা যায়, কেওড়া ফল পুষ্টির দিক থেকে প্রচলিত সব ফলকেই হারিয়ে দিচ্ছে। এতে রয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ শর্করা, ৪ শতাংশ আমিষ, ১ দশমিক ৫ শতাংশ চর্বি।
কেওড়ায় আরও মিলবে প্রচুর ভিটামিন, বিশেষত ভিটামিন সি ও এর যৌগগুলো। কেওড়া ফল বিভিন্ন ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যেমন পলিফেনল, ফ্ল্যাভেনয়েড, অ্যান্থোসায়ানিন, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও আনস্যাচুরেটেড ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে লিনোলেয়িক অ্যাসিডে পরিপূর্ণ।
কেওড়া ফল চায়ের মতোই শরীর ও মনকে সতেজ রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। কারণ, চায়ের চেয়ে এ ফলে ক্যাটেকিনসহ বিভিন্ন ধরনের পলিফেনল প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, যা চনমনে অনুভূতি দেয়। দেশি ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেনল রয়েছে আমলকী আর কেওড়া ফলেই।
এ ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলার তুলনায় অনেক বেশি পলিফেনল ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পলিফেনল এমন একটি উপাদান, যা আমাদের দেহে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, আর্থাইটিস, হৃদ্রোগ, অ্যালার্জি, চোখের ছানি, বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ ও ব্যথা-বেদনাসহ প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধ ও উপশম করে।
কেওড়া ফলে আমলকী, আপেল ও কমলার তুলনায় বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ও জিংক রয়েছে। এ ফলের আরও রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধী আর ব্যথানাশক গুণ। ফলটি ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের পীড়ার জন্য দায়ী জীবাণুকে কার্যকরভাবে দমন করতে পারে।
এ ছাড়া কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পালমিটিক অ্যাসিড, অ্যাস্করবাইল পালমিটেট ও স্টিয়ারিক অ্যাসিড। এই উপদানগুলো খাদ্যশিল্পে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ও তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। অথচ এগুলো কিনতে আমাদের গুনতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা। তাই কেওড়া ফলের প্রচলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বাড়লে সবদিক থেকেই উপকার পাব আমরা।