চকলেট শব্দটির সঙ্গে অদ্ভুত এক রোমান্স কাজ করে সব দেশের সব বয়সের মানুষের মধ্যে। একেক বয়সে এর আবেদন একেক রকম। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা স্মৃতি। চকলেটের মতোই যে স্বাদ কখনো তিক্ত, কখনো মিষ্ট। আজ বিশ্ব চকলেট দিবসে স্মৃতির পাতা উল্টে নস্টালজিক হলে বোধ হয় মন্দ হয় না।
আমাদের দেশের প্রাচীন খাদ্য সংস্কৃতিতে চকলেটের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া গেলেও চকলেটের অতুলনীয় স্বাদ-গন্ধ, বিলাসী মোলায়েম মখমল অনুভব আর বিশ্বব্যাপী চকলেটের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তা ও আবেদন এখন আমাদেরও সমানভাবেই উদ্বেলিত করে।
চকলেটের আছে হাজারো রকমফের। একেবারে বিষুবীয় অঞ্চল যেমন আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন ইত্যাদি দেশে পৃথিবীর বেশির ভাগ কোকো বিন উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া লাতিন আমেরিকার কিছু দেশেও চকলেটের উৎস, অর্থাৎ কাকাও গাছের চাষ হয়। সেই কাকাও গাছে উৎপন্ন কোকো বিন ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে নিয়ে গুঁড়া ও রোস্ট করে বিভিন্ন ধাপে কোকো ম্যাস তৈরি করা হয়। সেই কোকো ম্যাসকে আবার প্রক্রিয়াজাত করে কোকো পাউডার ও কোকো বাটার উৎপাদন করা হয়।
এরপর নানা কায়দায় এই কোকো বাটার আর কোকো পাউডারের সঙ্গে প্রয়োজনমতো চিনি, দুধ, ননি, ভেজিটেবল ফ্যাট ইত্যাদি উপাদান মিশিয়ে ডার্ক চকলেট, মিল্ক চকলেট আর হোয়াইট চকলেট তৈরি করা হয়। বিভিন্ন চকলেটজাত খাবার তৈরি করতে আবার চকলেট চিপ, কুকিং ও বেকিং চকলেট, কোকো পাউডার, চকলেট লিকার, চকলেট সিরাপ ইত্যাদি রূপেও চকলেট সারা বিশ্বে সমাদৃত।
বহু বছর ধরে কাকাও চাষ আর কোকো বিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিশুশ্রম, অন্যায্য পারিশ্রমিক, দৈনিক ভিত্তিতে অমানবিক লম্বা সময় ধরে পরিশ্রম আর পরিবেশের ক্ষতি—এ বিষয়গুলো বিশ্বমানবতার সামনে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে যাচ্ছে। এই তেতো সত্যগুলো চকলেটের মিষ্টতাকে ক্রমশই ম্লান করে দিচ্ছে—এ কথা বলা যায়। এখন চকলেট জায়ান্ট ক্যাডবেরি, হার্শিস, মার্স, ফেরেরো, লিন্ডট ইত্যাদি কোম্পানি ‘বিন টু বার’ মূলনীতি বজায় রেখে সরাসরি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে কোকো বিন নিজেদের চকলেট উৎপাদন কেন্দ্রে নিয়ে আসে। তাদের ব্রোশিয়র, ওয়েবসাইট এবং চকলেটের মোড়কেও এথিক্যাল ফার্মিং বা নৈতিকতা মেনে কাকাও চাষের নিশ্চয়তামূলক বার্তা থাকে।
পরিবেশের ক্ষতি না করে টেকসই পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও স্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন রক্ষা করার অঙ্গীকারনামা থাকলে সেসব চকলেট কোম্পানির সামগ্রীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন এখন ভোক্তারা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে কাকাও গাছের ফলন কমে যাচ্ছে। নানা ছত্রাকজাত রোগব্যাধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোকো বিন উৎপাদন। বিজ্ঞানীরা এমন পূর্বাভাস দিচ্ছেন যে অদূর ভবিষ্যতে সত্যিকারের চকলেট হয়তো আর পাওয়াই যাবে না। তাই তো উৎপাদনের ক্ষেত্রে কার্বন পদচিহ্ন কমানোর প্রত্যয় নিয়েছে সামনের দিনগুলোতে সব কটি বড় চকলেট কোম্পানি।
খাঁটি চকলেটের আছে অনন্য সব স্বাস্থ্যগুণ। তাই আজকাল দুনিয়াজুড়ে চকলেটপ্রেমীরা ঝুঁকছেন ডার্ক চকলেটের দিকে, যাতে প্রায় ৭০ শতাংশ কোকো আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, চকলেটে আছে মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি। এতে থাকা অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট আর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টগুলো আমাদের সার্বিক শারীরবৃত্তীয় ভালো থাকায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।
চকলেট খেলে বিষণ্নতা ও অবসাদ কাটিয়ে ওঠা যায়—এমনটি দেখিয়েছেন গবেষকেরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে হৃদ্যন্ত্র ভালো রাখা ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও চকলেটের ভূমিকা আছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এই কোকো বিনকে যত বেশি প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তত বেশি কমে আসতে থাকে এর উপকারিতা। সেদিক থেকে কোল্ড প্রেসিং করে কম তাপমাত্রায় উৎপাদিত কাকাও বাটার বা কাকাও নিবস, অর্থাৎ খোসা ছাড়িয়ে মোটা গুঁড়া করে নেওয়া কোকো বিন অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। বেশি তাপমাত্রায় রোস্টিং বা অক্সিডাইজ করে বানানো কোকো বাটার ও কোকো পাউডার স্বাদে–গন্ধে মনমাতানো হলেও এতে চকলেটের নিজস্ব পুষ্টিগুণ অনেকটা কমে আসে।
আবার এদিকে মিল্ক চকলেটে অতিরিক্ত চিনি, স্যাচুরেটেড ভেজিটেবল ফ্যাট ও মিল্ক ফ্যাট মেশানো হলে চকলেট মেদ বৃদ্ধি, মরবিড স্থূলতা, হৃদ্রোগ ও কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীরা এখন মাথা ঘামাচ্ছেন চিনির দানার বদলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পানিতে দ্রবীভূত চিনিকে চকলেটের অণুর চারদিকে রেখে চকলেট বানাতে, যাতে অল্প চিনিতেই সুস্বাদু ও বিলাসী অনুভূতিদায়ক চকলেট বানানো যায়। চকলেটের সঙ্গে নানা রকম স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন শুকনো ফল, তাজা ফল, বিভিন্ন বাদাম ও বীজের সমন্বয় ঘটিয়ে চকলেটকে আরও স্বাস্থ্যকর করে তোলার চেষ্টা চলছে ভোক্তাদের আগ্রহে। চিনির বদলে অন্যান্য প্রাকৃতিক মিষ্টকারক আগাভে, মধু বা স্টেভিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে এখন চকলেটে।
আগামী দিনে চকলেটের স্বাদ, ফ্লেভার ও অনন্য মসৃণ অনুভূতি বিশ্বের সব দেশে সবার কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর মনোভাব দেখা যাচ্ছে চকলেটের বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে। বিখ্যাত বেলজিয়ান চকলেটের অ্যালকোহল বর্জিত হালাল সংস্করণ তৈরি করছে গোডিভা ও লিওনিডার মতো চকলেট ব্র্যান্ড। চিনি, গ্লুটেন, বাদাম ও ল্যাকটোজমুক্ত চকলেট তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ফুড অ্যালার্জির কথা ভেবে। কোনো রকম প্রাণিজ উপাদান ব্যবহার না করে ভেজিটেরিয়ানদের উপযোগী চকলেট আছে সব ব্র্যান্ডেরই।
এমনকি চকলেটকে আরও সহজলভ্য ও সুলভ করতে কোকো বাটারের বদলে একেবারে বিশুদ্ধ নারকেল তেল ব্যবহার করে চকলেট তৈরি করা হচ্ছে।
চকলেটের সঙ্গে সব দেশের খাদ্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটছে এখন ফিউশনধর্মী চকলেটজাত সব অভিনব খাদ্যসামগ্রীর মাধ্যমে। এই ধারাবাহিকতায় আমরা তুর্কিস্তানে চকলেট বাকলাভা, আরবে চকলেট কাতায়েফ, জাপানে চকলেট মোচি, ভারতে চকলেট পান, চকলেট হালুয়া, এমনকি আমাদের দেশে চকলেট পাটিসাপটা বানাচ্ছি মনের মাধুরী মিশিয়ে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গের ‘মাছের ঝোল’ সিনেমার কথা। যেখানে বিখ্যাত বাঙালি শেফ অসুস্থ মাকে খাওয়াচ্ছেন চকলেট দিয়ে রান্না মাছের ঝোল, যা তিনি দারুণ সৃজনশীলতায় রেঁধে এবং তা খাইয়ে বিদেশিদের স্বাদকোরকে রসনার রায়ট বাধিয়ে দিয়েছেন। দেখা না থাকলে এ উপলক্ষে ছবিটা একবার দেখেও নেওয়া যেতে পারে বৈকি।
ফেরা যাক প্রসঙ্গে, আজকাল গণহারে উৎপাদিত চকলেট বারের চেয়ে হাতে বানানো, ক্রেতার ফরমাশ অনুযায়ী কাস্টোমাইজড চকলেটের চাহিদা বেড়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী, এমনকি বাংলাদেশেও।
আমাদের দেশে একসময় মিমি চকলেট ছাড়া তেমন কোনো চকলেট বার পাওয়া যেত না। এখন বিশ্বের স্বনামধন্য সব কোম্পানির চকলেট কিনতে পাওয়া যায় এ দেশে। বাংলাদেশে ভারী শিল্প পর্যায়ে কিছু কিছু কোম্পানি চকলেট তৈরি করলেও গত এক বছরে নারী উদ্যোক্তাদের ঘরোয়া পর্যায়ে তৈরি হাতে বানানো চকলেটশিল্পে এসেছে অভাবনীয় বিপ্লব।
চকলেট ব্যবহার করে বেকিং ও রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপকরণ এখন বেশ সহজে ও সুলভে পাওয়া যায় বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশে চকলেটের ক্ষেত্রে নতুন দিনের হাতছানি দেখছি আমরা। চকলেটের অনন্য মিষ্টতা, রোমান্টিকতা, ভালোবাসাময়তা আর মখমলি অনুভবে সবাই ভুলে যাক তিক্ততা। স্বাস্থ্যকর, টেকসই, সুনৈতিক চকলেটের মিষ্টি স্বাদ ও গন্ধে জয়জয়কার হোক বিশ্বমানবতার—চকলেট দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
অন্যান্য ছবি: পেকজেলস ও উইকিপিডিয়া