সকালের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর নাশতা পান্তা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে সকালে পেঁয়াজ, পোড়া মরিচ আর নুন সহযোগে মুখে দিয়ে দিনের শুরু করে আসছেন গ্রামবাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে। এখন পুষ্টিবিদেরা বলছেন, এই পান্তা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর সকালের নাশতাগুলোর একটি। এতে আছে অনন্য সব স্বাস্থ্যগুণ। এ জন্য পান্তাকে গরম ভাতের চেয়েও পুষ্টিকর বলছেন বিশেষজ্ঞরা। খোদ মার্কিন মুলুকের আমেরিকান নিউট্রিশন সোসাইটি এই পান্তা নিয়ে গবেষণা করে পেয়েছেন চমকপ্রদ তথ্য। আগের দিনের ভিজিয়ে রাখা ভাতে বেড়ে যায় পুষ্টিগুণ। আর এই ভাতে ক্যালরি কিছুটা বেশি থাকায় সকালের নাশতায় খাওয়াই ভালো পান্তা। আয়রন, পটাশিয়াম আর ক্যালসিয়াম বহু গুণে বেড়ে যায় পান্তা—এ তথ্য গবেষণাতেই উঠে এসেছে। তাই আমরা সেই সনাতন খাদ্যাভ্যাসের দিকে ফিরে যেতেই পারি রোজ সকালে।

পান্তা আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। পান্তাবুড়ির ছেলেভোলানো গল্প ফেরে সবার মুখে মুখে। গানের সুরেও পান্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাপপ্রবাহ অথবা ভ্যাপসা গরমের দিনে নানা পদের ভর্তা আর অনবদ্য পোড়া মরিচ ও কাঁচা পেঁয়াজের যুগলবন্দীর সমন্বয়ে পান্তার আয়োজন নিঃসন্দেহে তৃপ্তি দেবে যেকোনো বেলায়। আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া বাংলাদেশি রন্ধনশিল্পী কিশোয়ার চৌধুরীর কল্যাণে ফাইন ডাইনিংয়েরও অংশ হয়ে উঠেছে এখন আমাদের পান্তাভাত।
পান্তার পুষ্টিগুণ গরম ভাতের তুলনায় বেড়ে যায় বিস্ময়করভাবে। আসলে ফার্মেন্টেড খাদ্য সব সময়ই অত্যন্ত পুষ্টিকর।

সাদা ভাতের চেয়ে অবশ্য লাল চালের ভাত পান্তা করলে তার পুষ্টিগুণ বেশি। এতে সারা রাত ভিজে ভাতের শোষণযোগ্য আয়রন, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম বৃদ্ধি পায় অনেক গুণ। ভিটামিন বি৬ আর বি১২-এর অনন্য উৎস এই পান্তা। এই দুটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পান্তায় যেভাবে মেলে, তা অন্য নিত্যকার খাবারে পাওয়া যায় না। কিছুটা গাঁজন প্রক্রিয়া ঘটে সারা রাত পানি দিয়ে রাখা ভাতে। এর ক্যালরিও বেড়ে যায় অবশ্য। এ জন্যই পান্তা খেলে কর্মশক্তি মেলে বেশি।

বিজ্ঞাপন

রোজ সকালে পান্তা খেলে যেসব উপকার মিলবে
১. সকালের নাশতায় পান্তাভাত সারা দিন শক্তি জোগান দিতে পারে। এ জন্য লাল চালের পান্তা সবচেয়ে ভালো।
২. পান্তার উপকারী ব্যাকটেরিয়া হজম ও রোগপ্রতিরোধে সহায়তা করে অত্যন্ত কার্যকরভাবে। আর একবার শরীরে নিয়মিত এই ব্যাকটেরিয়া উপস্থিতি জানান দিলে তাদের আবাস বা বায়োম গড়ে ওঠে পরিপাকতন্ত্রে।
৩. রোজ এই পান্তা দিয়ে প্রাতরাশ সারলে পেটের সমস্যা দূর হয় ধীরে ধীরে। এখন পুষ্টিবিদেরা বলেন, ভাত বা রুটির চেয়ে হজমে সুবিধাজনক। আর অনেকেরই গ্লুটেন ইনটলারেন্স থাকতে পারে। সেদিক থেকেও ভাত ভালো। আর পান্তা আরও ভালো এতে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়ার কারণে।

৪.আঁশযুক্ত চালের ভাত দিয়ে পান্তা বানালে তা সবদিক থেকে ভালো। রোজ তা দিয়ে সকালের নাশতা করলে কোষ্ঠ পরিষ্কার থাকবে। আঁশের আরও অনেক উপকারী গুণ আছে। বিশেষত হৃদ্‌রোগ ও ডায়াবেটিসের জন্য।
৫. পান্তা নিয়মিত খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। খারাপ কোলেস্টেরলের দৌরাত্ম্যও কমে আসবে। এমনিতে সবাই বলে পান্তা খেলে ওজন বাড়ে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। সঠিক পরিমাণে খেলে ও সারা দিন সচল থাকলে বরং গরম ভাতের চেয়ে পান্তা ভালো।

৬. দিনের কাজকর্মে ক্লান্তি ভর করার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যাবে সকালে পান্তা খেয়ে বের হলে। এর ফলে এলোপাতাড়ি স্ন্যাক্স ও চিনিযুক্ত পানীয় থেকে বাঁচা যাবে দিনভর। দেখতেও লাগবে সজীব ও সতেজ।
৭. সারা দিন চা-কফি পান করার অনেক খারাপ প্রভাব রয়েছে। পান্তার শক্তিদায়ী প্রভাব অনেকটা সময়জুড়ে থাকে। শরীর ও মনকে রাখে চনমনে। তাই অযথা ক্যাফেইন গ্রহণ করা হয় কম।

বিজ্ঞাপন

পান্তার রেসিপি বলে আসলে কিছু নেই। রাতের ভাত পাতিলে পানিসহ ভিজিয়ে রেখে দিলেই তা সকালে খাওয়া যায় আয়েশ করে। কাঁচা পেঁয়াজ আর পুড়িয়ে নেওয়া শুকনা মরিচ তো লাগবেই। থাকতে পারে আগুনঝাল শুঁটকিভর্তা। তাতে যেন রসুন-মরিচ পড়ে একটু বেশিই। আলুভর্তা ও ডিমভাজা দিয়েও এই বাঙালির কমফোর্ট ফুড পায় অন্য মাত্রা। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা আবার নারকেলের টুকরায় কামড় দেন পান্তা খেতে খেতে। কেউ কেউ ভালোবাসেন পান্তার সঙ্গে কড়কড়ে মাছভাজা। মাংসের শুঁটকির ভর্তা, চ্যাপা ভুনা, আগের দিনের বাসি তরকারিও পান্তার সঙ্গে মানিয়ে যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা পান্তাকে বাঙালিয়ানার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ালেও ভারতের অনেক অঞ্চলেই এভাবে ভাতে পানি দিয়ে সারা রাত রেখে সকালে খাওয়া হয় ঐতিহ্যগতভাবে। আসামে পইতাভাত, তামিলনাড়ুতে পাঝায়াসাধাম, ওডিশায় পাখালাভাত আর তেলেগু ভাষায় যাকে চাড্ডানাম বলে, সেই পরম সুখাদ্যটি আমাদেরই চিরচেনা পান্তাভাত। তবে এমনিতে নিয়মিত না খেলেও এমন নিদারুণ তাপপ্রবাহের দিনে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, ইফতার, সাহ্‌রি—সব সময়ই ভাতে পানি দেখলেই জিবে জল আসতে বাধ্য যেকোনো বাঙালির।


তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু, দ্য বেটার ইন্ডিয়া
ছবি: পারভীন আলী

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১: ৫১
বিজ্ঞাপন