আদায় কাঁচকলায় কথাটি কেন যে শত্রুতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, সে এক রহস্য। নয়তো সঠিকভাবে কষানোর মুনশিয়ানায় নামমাত্র আদাবাটা আর ছুতোমিছি হলুদেই কাঁচকলার ঝোলে হয় অমৃতের স্বাদ, সোনারঙা রূপ। শেষে দুটো কাঁচামরিচ চিরে দিলে তো সোনায় সোহাগা। চলতে পারে শিং মাছ দিয়ে এর আমিষ সংস্করণও।
আদা এক সর্বজনীন আর অত্যাবশ্যক মসলাবিশেষ। আর এর ব্যবহারও বেশ সরল, তা আদার যতই গেরো থাক। আমাদের উপমহাদেশে যারা নিরামিষভোজী, তারা পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার না করলেও আদা ছাড়া রান্না-খাওয়া কল্পনাই করতে পারেন না। নিরামিষ রন্ধনশালায় তেলে ফোড়নের পরে অনেক পদে আদাই পড়ে সবার আগে। আবার মাংসের দেশি, মোগলাই, আফগান, পার্সি সব পদেরই প্রাণভোমরা আদাবাটা। আদা মাংসের রোয়া নরম করে বলেই এর কদর বেশি লাল মাংস রান্না করতে। কাবাবেও অপরিহার্য তাই আদাবাটা।
তবে কাবাবের সঠিক ঝলসানো ভাব নিশ্চিত করতে আদা পানি ছাড়াই বাটতে হবে। কোরমার আদাবাটা হবে মাখনের মতো মোলায়েম আর মিহি। আদা কুচিয়ে ব্যবহার হবে ঝাল ফ্রেজি বা আমাদের চিরচেনা কাটা মসলার মাংসে। মেজবানি মাংস, কোরমা, মোরগ পোলাও, আখনি পোলাও, ঢাকাই রেজালা, জামালপুরের পিঠালিসহ সব মাংস রান্নায় আদাবাটার সঠিক ও যথেষ্ট ব্যবহারই মনমতো ফ্লেভার ও স্বাদ দিতে পারে।
শুধু আমাদের উপমহাদেশে নয়, আদার কদর রয়েছে সারা বিশ্বেই। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়া ১৪০০ শতাব্দীর দিকে কোনো বিষয়ই ছিল না। কারণ, এক পাউন্ড আদা তখন বিকাত একটি ভেড়ার দামে। মাটির নিচে অনিয়মিত কান্ড রূপে এই আদা জন্মায় গ্রীষ্মপ্রধান প্রায় সব দেশেই। তবে ওরিয়েন্টাল খাবারে ব্যবহৃত গালাংগাল আদা বেশ আলাদা আমাদের আদা থেকে। আদাবাটা প্রায় সময়ই অনেক পদের গ্রেভির বেস তৈরি করে, আবার ম্যারিনেডে প্রাণ জোগায়। ঝাল ও মিষ্টি—সব রকম খাবারেই আদার ব্যবহার রয়েছে। এক চিমটি আদার জাদু প্রাণ জোগায়, অনেক ওপরে তুলে ধরে বাকি সব মসলাপাতির সম্মিলিত ফ্লেভারটিকে।
আদার ঔষধি গুণের সুবিধা নিয়ে বমিভাব কাটাতে, পেটের পীড়ায় বা সর্দি-কাশিতে চলে আদা–চা, কুচোনো তাজা আদা বা আদার ঝাঁজে বানানো চিকেন স্যুপ বা ভিয়েতনামি ফো। ওরিয়েন্টাল খাবারে আদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থাই টম ইয়াম গুং, কোরিয়ান বুলগগি, জাপানি সুশিতে আদার পিকেলস, ক্যান্টনিজ স্টিমড ফিশ, চায়নিজ স্টার ফ্রাই বা ফিলিপিনো আদোবো—আদাই নেতৃত্ব দেয় মসলার দলে।
এ ক্ষেত্রে তারা আদাবাটার চেয়ে জুলিয়েন বা লম্বা কুচি, ছেঁচে নেওয়া বা ঝুরি করা আদা বেশি ব্যবহার করে। অথচ পৃথিবীর এদিকে আবার মিহি করে বাটা আদার কদর বেশি। তবে নিহারিতে ব্যবহৃত শুকনো আস্ত আদা বা সওটের ফ্লেভার আবার একেবারেই আলাদা। কাশ্মীরি আচারে আবার স্লাইস করা আদা দেওয়া হয় ফুলের নকশা করে কেটে।
পশ্চিমা খাদ্য সংস্কৃতিতে আবার মিষ্টি খাবারে আদার ব্যবহার আমাদের দেশের চেয়ে অনেকটাই বৈচিত্র্যময়। ইউরোপে-আমেরিকায় খুবই জনপ্রিয় জিঞ্জারব্রেড ম্যান, জিঞ্জার স্ন্যাপ্স কুকিজ এবং ক্যারট জিঞ্জার কেক। বিলাতে তো বিয়ারে আদার টুকরা দীর্ঘকাল রেখে জিঞ্জার এইল তৈরি করা হয় আদার ফ্লেভারে। প্রাচীন ফ্রান্সের একটি বিশেষ মসলা মিশ্রণ ‘কাত্রে এপিসেস’–এও শুকনো আদার চূর্ণ ব্যবহার করা হতো।
আদার ব্যবহার যেমন সর্বজনীন, রন্ধনপ্রণালিতে প্রয়োগের কায়দা অনুযায়ী এর স্বাদ ও ফ্লেভারে আছে অনন্য বৈচিত্র্য। হেঁশেলে আদা না থাকলে ঝাল-মিষ্টি, আমিষ-নিরামিষ—সব পদই হয়ে যেত নিষ্প্রাণ। তাই আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর না নিলেও হেঁশেলের খবর না নিয়ে উপায় নেই।
ছবি: পারভীন আলী