মাচানে চলছে ভরপুর ভর্তা উৎসব
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ভর্তা-ভাতে অরুচি আছে এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই ভর্তার উৎসবের আহ্বানে সেদিন যাওয়া হলো ঢাকার গুলশান লেক রোডের মাচান রেস্তোরাঁয়। হাতিরঝিল থেকে ইউটার্ন নিয়ে গাড়ি যখন গুলশান লেকের প্যারালাল রাস্তায় উঠল তখনই আমি ফিরে গেলাম ৩৭ বছর আগে। চট্টগ্রাম থেকে কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ আর মাথায় তোশক নিয়ে হাজির হয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলে। প্রথম দিনই একটা নাটক করে হলে রুম পেয়ে যাই, বরাদ্দ ছাড়া, ৪১৫ নম্বর রুম।

সেখানে ব্যাগ–তোশক রেখে বের হই রাতের খাবারের জন্য। ক্লাসের আরও দুই দিন বাকি। ক্যানটিন বন্ধ। অন্য কিছু নেই আর তেমন কিছু চিনিও না।
চাচা ছিলেন রেলের ইঞ্জিনিয়ার। আমার ২২ বছর আগে একই ক্যাম্পাসে পড়েছেন। তাঁর কাছেই শুনেছিলাম হাছিনা হোটেলের কথা। মেডিকেল হোস্টেলের উল্টো দিকে। কোনো কিছু না পেয়ে সেই ভরসায় বকশীবাজারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল ইসলাম হলের গেট পার হয়ে মেডিকেল হোস্টেলের দিকে গেলাম। একটু পর পেলাম পপুলার হোটেল। কিন্তু হাছিনা হোটেল পেলাম না। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পপুলারেই ফিরে গেলাম। তখনই জানলাম চাচাদের আমলের হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে স্বাধীনতার পর।

বিজ্ঞাপন

ক্লাস শুরু হলো। মেস চালু হলো। এক বেলা সাড়ে চার টাকা। দিনের খরচ ৯ টাকা। তিন দিন এক বেলার খাবার বন্ধ রাখলে পরের মাসে টাকা বাঁচানো যায়। মাসের শেষের দিকে এই পদ্ধতি খাটাতে হতো।এর মধ্যে দুটি খাবারের জায়গার সন্ধান পেয়ে গেলাম। একটা হাজির বিরিয়ানি। তবে সেটা মাসে একবারের বেশি খাওয়া কঠিন।

আরেকটা পেলাম নাজিমুদ্দিন রোড ধরে একটু ভেতরের দিকে। নাম নীরব হোটেল। নতুন  খুলেছে তখন। বিরিয়ানি করে না। সাদা ভাত আর বহু পদের মুখরোচক ভর্তা-ভাজি। কবজি ডুবিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া যায়। একবার খেলে আবার খেতে মন চায়।
যত দিন ক্যাম্পাসে ছিলাম, নীরবের সঙ্গে সখ্য ছিল খুব। এমন সখ্য যে সেটি ক্যাম্পাস ছাড়ার পরও অব্যাহত থাকল। তত দিনে অবশ্য সেটি দোতলা হয়েছে। ক্যাম্পাস ছাড়লেও ভর্তা-ভাজির ওপর আকর্ষণ থেকেই গেল। কিন্তু লেকের পাড়ে বৃষ্টির দিনে ধীরেসুস্থে ভর্তা-ভাত খেতে খেতে গল্প করার সুযোগ আর সুবিধা খুঁজে পাওয়া ভার।

সবই দেখি বিরিয়ানি ধরনের খাবার। হয় কাচ্চি না হয় মোরগ–পোলাও। কিন্তু সাদামাটা ডাল-ভাত সঙ্গে ভর্তা পেলে যেন বেশ হতো! ঈদের দুই দিন আগে জানলাম মাচান রেস্টুরেন্টে একটা ভরপুর ভর্তা উৎসবের আয়োজন হবে—৩ থেকে ৮ জুলাই।  সময়টা দারুণ। কারণ, কোরবানির ঈদের পর মাংস খেতে খেতে অন্য সবার মতো আমারও একঘেয়ে লাগছে। ১০টির বেশি ভর্তা পদের সেই সমাহারে থাকবে কচু বাটা, পটোলভর্তা, জাম আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, বাদামভর্তা, কালোজিরাভর্তা, চ্যাপা শুঁটকিভর্তা, ডিমভর্তা, মাছভর্তা, মরিচভর্তা, টক ডাল, আলুঝুরি, আমতেলসহ নানা মুখরোচক পদ।

বিজ্ঞাপন

এসব ভাবতে ভাবতে প্রিয় একজন বন্ধুস্থানীয় সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম মাচান রেস্টুরেন্টে। ভর্তা-ভাত কি আর একা খেয়ে মজা আছে! গুলশান-২-এর শাহজাদপুর লেকড্রাইভ রোডে, মরিয়াম টাওয়ার ১ ও ২-এর মাঝখানে লেকপাড়ে একটা দোতলা বাড়ি। আলাদা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথ। ঢোকার পরপরই প্রথম চমক। পুরো জায়গাটি সাজানো হয়েছে বাঁশের নানা সামগ্রী দিয়ে। বুঝলাম এ জন্যই ‘মাচান’ নাম।

তর সইছিল না। কাজেই তালিকা না দেখে ভর্তা–ভাতের অর্ডার করলাম। আজকাল হোটেল–রেস্তোরাঁয় একটা ‘ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক’ দেয়। সেটা এসে গেল। জিরা পানি। অনেক দিন পর এল কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার দিন। দুপুরে অর্ধেক প্লেট ভাতই খাওয়া হয় রোজ। কিন্তু সেটা জানতে দিলাম না। ১০ পদের ভর্তা সাজানো প্লেট নিয়ে আসার পরপরই নস্টালজিয়া ঘিরে ধরল। এরপর ভর্তা-ভাতের পাতে ঝাঁপিয়ে পড়া। তাল সামলে শুঁটকিভর্তা ফেরত দিলাম। কারণ, চাটগাঁর লোক হলেও আমি কেন জানি শুঁটকি খুব একটা পছন্দ করি না। শুরুতে টের না পেলেও একসময় টের পেলাম অন্য দিনের তুলনায় বেশি ভাত খাওয়া কঠিন। একটু দম নেব কি না ভাবছি। ওয়েটার টের পেয়ে বলল, ‘স্যার, আরও সময় নিয়ে খান। খেতে পারবেন!’ দেখা গেল তার কথাই সত্য। ঠিকই সবটুকু খেতে পারলাম। ভর্তা-ভাত বলে কথা!

সেদিনের প্রতিটি ভর্তা প্রবল মমতা দিয়ে বানানো ছিল। আমি ভোজনরসিক না হলেও খেতে ভালোবাসি। রান্নার মমতা আমি টের পাই। সেটা একেবারে শতভাগ টের পেয়েছি। প্রতিটি ভর্তা মনোযোগ দিয়ে খেয়েছি। কারণ, আমার পাতে শেষমেশ কিছুই আর থাকল না। এক গ্লাস আমের শরবত (এটা প্যাকেজের বাইরে) দিয়ে শেষটুকুও চমৎকার হলো।
অনেক দিন ধরে যাঁরা একটু ভিন্ন কিছু দিয়ে দুপুর বা রাতের খাবারের কথা ভাবছেন, তাঁরা নির্দ্বিধায় মাচানের ভরপুর ভর্তা উৎসবে হাজির হতে পারেন। নস্টালজিয়া তো পরিপূর্ণতা পাবেই, তৃপ্তিও মিলবে নিঃসন্দেহে।

ছবি: মাচান

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১১: ৫৪
বিজ্ঞাপন