জিনস, টি-শার্টের সঙ্গে ধাতব স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি ঝোলানো ইয়ার রিং অথবা কুর্তি এমনকি শাড়ির সঙ্গে ফেলে দেওয়া বোতলের ক্যাপ বা ভাঙা চিনামাটির তৈজসের টুকরো রাঙিয়ে বানানো পেনড্যান্ট পরলে তা নজর কাড়তে বাধ্য। আবার পৃথিবীর পরিবেশ বাঁচাতে ফেলনা জিনিস দিয়ে তৈরি গয়না ও অ্যাকসেসরিজ ব্যবহার করে যে এক আত্মতৃপ্তির অনুভূতি কাজ করবে মনে, তা অমূল্য। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সাসটেইনেবল বা টেকসই ফ্যাশনের কোনো বিকল্প নেই পৃথিবীকে বাঁচাতে। অলংকারের ক্ষেত্রেও এই পরিভাষা নিজস্ব রূপ তৈরি করে নিয়েছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম তাদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির বদৌলতে রিসাইকেলিং, আপসাইকেলিং, রিইউজের ধারণাগুলো গয়না তৈরি থেকে শুরু করে ব্যবহার পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিশ্চিত করছে।
বিশ্বজুড়েই গতানুগতিক ধারার গয়নাগুলোর উপকরণ সংগ্রহ থেকে শুরু করে তৈরি করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে অপরিসীম দূষণের শিকার হচ্ছে আমাদের পৃথিবী, হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য। সোনা, হীরা ও অন্যান্য জেমস্টোনের জন্য মাইনিং বা খননকাজের ফলে অবর্ণনীয় রকমের বায়ুদূষণ ঘটে। ফিউম, স্মগ বা বিষাক্ত ধোঁয়াশায় বিনষ্ট হয় স্বাস্থ্য। সায়ানাইডসহ বিভিন্ন টক্সিক রাসায়নিক পদার্থ মিশে যায় জলাশয়ে। অ্যাসিড মিশে গিয়ে পানির পিএইচ ভারসাম্য নষ্ট করে। এ ছাড়া বিভিন্ন কৃত্রিম পদার্থ দিয়ে অথবা অন্যান্য ধাতু গলিয়ে অলংকার তৈরিতে পরিবেশের ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বিভিন্নভাবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে একটি অত্যন্ত দায়িত্বশীল বিকল্প হতে পারে ফেলে দেওয়া বিভিন্ন উপকরণ থেকে তৈরি রিসাইকেলড জুয়েলারি।
প্রযুক্তি ও তারুণ্যের শক্তি একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে এ পৃথিবীকে তার হারানো সজীবতা ফিরিয়ে দিতে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে রিসাইকেলড জুয়েলারি। কফি কাপ, বোতল লাঞ্চবক্স, র্যাপিং পেপার, প্লাস্টিক বা নিয়ন ব্যাগ, হার্ডবোর্ড, বোতাম, ফেলনা অ্যালুমিনিয়াম, টিন, সিলিকন, ঘরের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস—সবকিছুই নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করে রিসাইকেলড জুয়েলারি বানানো যায়। শুধু প্রয়োজন সৃজনশীল মন।
কাটিং ও প্যাচওয়ার্ক, টুইস্টিং ও আয়রনিং ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় রিসাইকেলড জুয়েলারি বানানো যায়। রিসাইকেল করা ফেব্রিকের কাজের গয়নাও এর মধ্যে পড়ে। ইলেকট্রোফর্মিং প্রক্রিয়ায় ধাতুর প্রলেপ দিয়ে রিসাইকেলড গয়না বানান অনেকে। পুরোনো প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর ধাতুর প্রলেপ দেওয়ার ফলে বিবর্ণ ভাব কাটিয়ে তা এক নতুন ধরনের অ্যান্টিক লুক পায়। পুরোনো স্মৃতি নতুন রূপে সংরক্ষণ করা যায় এভাবে। পুরোনো সোনা বা রুপার গয়নাও বিভিন্নভাবে রিসাইকেল হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। তরুণ উৎসাহী উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই অবশ্য হ্যান্ড পেইন্ট তথা রংতুলির সাজেই রিসাইকেলড গয়না সাজিয়ে থাকেন। পুরোনো কাপড়, কাঠের টুকরা, ছিঁড়ে যাওয়া পুঁতির মালা—এই সবকিছুর ওপরেই বাহারি রঙের পেইন্ট করে অনেকেই নানা ডিজাইনের রিসাইকেলড জুয়েলারি বানিয়ে থাকেন পৃথিবীর সব দেশেই। আশার কথা, চাকচিক্যময় নিত্যনতুন গয়নার পাশাপাশি আমাদের দেশেও রিসাইকেলড জুয়েলারি নিয়ে প্রচুর আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
অতিমারিকালে পরিবেশ, পৃথিবী, দূষণ ও জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখেছি আমরা। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের চারুকলা বিভাগের দুই নবীন শিক্ষার্থী আফীফা আমিন ও আফরিন আশা ফেলে দেওয়া উপকরণ দিয়ে পরম নিষ্ঠায় তৈরি করেন রিসাইকেলড জুয়েলারি। বন্ধুমহল তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে এখন তাঁদের বানানো ইয়ার রিং ও পেনড্যান্ট নিজস্ব পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বহু মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি করছে।
আফীফা আমিন। ক্যাসিয়া নামেই পরিচিত বন্ধুদের কাছে। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের চারুকলার শিক্ষার্থী। গ্রাফিক ডিজাইন তাঁর পাঠ্য বিষয়। ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে তিনি সময় কাটাতে এবং পরিবেশের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে চারদিকে পড়ে থাকা ফেলনা জিনিস দিয়ে গয়না, ব্যাজ ইত্যাদি তৈরি করতে শুরু করেন নিজের সৃষ্টিশীল প্রতিভার বলে। সবার কাছে বেশ প্রশংসা পেয়ে তিনি এ কাজটি আরও মনোযোগসহকারে করতে শুরু করেন। তিনি লক্ষ করলেন, দোকানে কোমল পানীয়ের কাচের বোতলগুলো রিসাইকেল করা হলেও বোতলের ক্যাপ পড়ে থাকে সর্বত্র। তিনি নিজেই এই ফেলে দেওয়া বটল ক্যাপ আপসাইকেল করে সেগুলো দিয়ে ইয়ার রিং ও পেনড্যান্ট বানাতে শুরু করলেন। যেগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আশা করি, আমি যা করেছি, তা অন্যদের পরিবেশ বাঁচাতে এবং আমাদের আশপাশের ফেলনা জিনিস দিয়ে আকর্ষণীয় কিছু তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করবে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছেন আফরিন আশা। ডাকনাম বুশরা। সদা হাস্যময় এই তরুণ উদ্যোক্তা অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি কাজ করছেন রিসাইকেলড জুয়েলারি নিয়ে। তাঁর সিগনেচার গয়না হচ্ছে ব্রোকেন গ্লাস পেনড্যান্ট। একেবারে আলাদা রকমের ব্রোকেন গ্লাস পেনড্যান্ট বানানো শিখেছেন ২০১৮ সালে, একটি কর্মশালা থেকে। সেখানে বিভিন্ন জিনিসপত্র রিসাইকেল করে কীভাবে গয়না বানানো যায়, তা শেখানো হয়েছিল। এরপর থেকেই তিনি শখের বশে ভেঙে যাওয়া তৈজসপত্র থেকে পাওয়া কিছু ব্রোকেন গ্লাস পেনড্যান্ট তৈরি করেন এবং এগুলো নিয়ে একটি মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি অবাক হয়ে দেখেন, মেলায় তাঁর তৈরি করা সব কটি পেনড্যান্টই বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর থেকে ঘরে যত কাচের প্লেট ভেঙে যায়, তার টুকরোগুলো তিনি সংগ্রহ করে রেখে দেন। ভাঙা টুকরোগুলোতে পুরোনো কাপড় আঠা দিয়ে পেঁচিয়ে শুকিয়ে নিতে হয় প্রথমে। পুরোপুরি শুকানোর পর সেগুলোর ওপরে তিনি পেইন্টিং করেন মনের মতো করে।
সুন্দর এই পৃথিবীটা আমাদের। আর আমাদের সচেতনতাই একে সজীব ও সবুজ রাখতে পারে। মূলধারার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির দূষণ ও ভয়াবহতার বিপরীতে আমাদের জীবনধারার ছোট ছোট পদক্ষেপ টেকসই ধরনের হওয়া ও রিসাইকেলিংয়ের আওতায় আনা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। টেকসই উপাদানে তৈরি টেকসই পোশাকের সঙ্গে টেকসই গয়নার ব্যবহারকেও প্রচলিত করে তোলা আজ আমাদের দায়িত্ব। আর এসবের মাঝে সুখবর হলো, এক নির্ভরযোগ্য সমীক্ষামতে বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের শতকরা ৭০ শতাংশ রিসাইকেলড ও টেকসই পণ্যভোগে আগ্রহী। রিসাইকেল করা গয়না তৈরি, ক্রয় ও ব্যবহারের উদ্দীপনা গয়নার চাকচিক্য নয়, বরং পরিবেশ বাঁচাতে নিজের ভূমিকা নিশ্চিত করার তাগিদ। আমাদের দেশে আফীফা ও আফরিনের মতো প্রত্যয়ী তরুণ পরিবেশবাদী ও তাঁদের ক্রেতাসমষ্টির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রিসাইকেলড জুয়েলারির ক্ষেত্রে বিপ্লব আসতে যাচ্ছে, এ কথা বলাই যায়।