হাল ফ্যাশন ডেস্ক
ডেনিমকে ধরা হচ্ছে বাংলাদেশের ফিউচার ফেব্রিক হিসাবে। তবে এই চিরাচরিত আবেদনসম্পন্ন ফেব্রিকের প্রতি দেশের তরুণ প্রজন্মের আছে ক্রমবর্ধমান ঝোঁক। তাই ২৫-৩৫ বছর বয়সী মেয়েদের কথা মাথায় রেখে ডেনিম দিয়ে শরৎ-শীত ২০২৩-এর জন্য একটি স্ট্রিট কালেকশন করেছেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফএফটি) ফ্যাশন ডিজাইনের ছাত্রী রোজিনা সুলতানা। ফেব্রিক ও ডিজাইনের ক্ষেত্রে নতুন আমেজ দেওয়া এই সংগ্রহে রয়েছে মোট ২০টি পোশাক।
গঠনগতভাবে ডেনিম একধরনের মজবুত টুইল কাপড়। টুইল বুননে একটি তির্যক লাইন তৈরি করা হয়। সাধারণত ডেনিম বিভিন্ন রঙে পাওয়া যায়, তবে এর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আদি রূপটি হচ্ছে ইন্ডিগো ডেনিম। এই ডেনিম বোনার সময় টানায় রঙিন সুতা ব্যবহার করা হয়। আর ভরনায় থাকে সাদা সুতা। ফলে পেছনের অংশটি থাকে সাদা।
ডেনিম তৈরি নিয়ে সবার মাঝেই অনেক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তবে বর্তমানে পরিবেশদূষণ এবং পানির অপচয় কমিয়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ডেনিম তৈরি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোজিনা কাজ করেছেন ইল্যুশন (ব্লু) নামের লেডিস ওয়্যার কালেকশন নিয়ে। এখানে একেবারে নতুন ডেনিম উৎপাদনের পাশাপাশি ডেনিম তৈরিতে পুরোনো কাপড় পুনরায় ব্যবহার করে আপসাইক্লিংও করা হয়েছে। এ ছাড়া লেজার টেকনিক এবং জিরো ওয়েস্ট প্যাটার্ন টেকনিক প্রয়োগ করে এই ডেনিমের সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই কালেকশনের ডিজাইনে স্ট্রিট লুককে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ডেনিমের ওয়াশ এবং মোটিফে নতুনত্বের ধারণা স্পষ্ট। থিমনির্ভর কালেকশন তৈরিতে আগ্রহী এই নবীন ডিজাইনার। তবে এই কালেকশন সাজানোর আগে রোজিনা বেশ সুচিন্তিত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন ক্রেতাদের চাহিদা জানার উদ্দেশ্যে। কর্মজীবী তরুণীরা, যাঁরা চান যে তাঁদের নিত্যদিনের পরার পোশাক একই সঙ্গে ফ্যাশনেবল ও আরামদায়ক হোক, তাঁদের কথা ভেবেই এই ডিজাইনগুলো করা। কিছু সমীক্ষা ও তথ্য–উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করে রোজিনা এ–ও বুঝতে পারেন যে স্ট্রিট স্টাইলের প্রতিই এই ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। এই ব্যাপারগুলো তিনি তাঁর কালেকশন ডিজাইন করার সময় খেয়াল রেখেছেন।
দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে রোজিনা তাঁর ডিজাইনে জামদানি মোটিফ ব্যবহার করেছেন। লেজার টেকনিকের মাধ্যমে জামদানি মোটিফ ব্যবহার করে তিনি ফিউশনধর্মী কাজ করেছেন এখানে। রোজিনা ঐতিহ্যবাহী জামদানির মোটিফকে একেবারে আধুনিক রূপে লেজার টেকনিককে কাজে লাগিয়ে জমিন অলংকরণ করেছেন।
রোজিনা তাঁর এই সংগ্রহে গার্মেন্টস শিল্প থেকে পাওয়া ডেনিমজাতীয় ফ্যাশন ওয়েস্ট ও স্ক্র্যাপ ফেব্রিক এবং সেই সঙ্গে জামদানি ফেব্রিক ব্যবহার করেছেন। আপসাইক্লিং পদ্ধতিতে তৈরি এই কাপড়গুলো যথার্থ অর্থেই জীবাণুবিয়োজ্য ও পচনশীল; অর্থাৎ অন্যান্য জৈব পদার্থের মতোই সময়ের সঙ্গে এটি ক্ষয় হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায় কোনোরকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলা ছাড়াই। টুইল ফেব্রিক বেশ শক্তিশালীএবং তা দিয়ে তৈরি পণ্যগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই কালেকশনের জন্য গার্মেন্টস স্ক্র্যাপ ফেব্রিক এবং পুনর্ব্যবহৃত ফেব্রিক ব্যবহার করে তিনি পরিবেশ বাঁচানোর জন্য ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। কারণ, এসব কাপড় এমনিতে ফেলেই দেওয়া হতো, তা পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ যেমন কমেছে, তেমনি একটি সম্পূর্ণ নতুন পোশাক বানাতে যে সম্পদ ও শক্তি ব্যবহার হতো, তা রক্ষা করা গেছে।
তবে এই কাপড় রিইউজ করা ভালো কারণ এ থেকে ফাইবার বা সুতা তৈরি করতে গেলে সেই শক্তি ও সম্পদ অপচয় হতো। রোজিনা খুব সচেতনভাবেই তার কালেকশনের পরিকল্পনা করেছেন বর্জ্য কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টাকে মাথায় রেখেই। পোশাকে ব্যবহার করার পর তিনি বেঁচে যাওয়া ডেনিম ফেব্রিক দিয়ে ব্যাগ তৈরি করেছেন। এখানেও আপসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তিনি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছেন। জিরো ওয়েস্ট মূলনীতি অনুসরণ করেছেন তিনি এই কালেকশনের প্রতিটি ধাপে।
তাঁর সংগ্রহে ব্যবহৃত ডেনিম ও ব্রোকেড ফেব্রিক বেশ টেকসই। পোশাকের ফিটিংও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামদায়ক। চলাচল ও কাজকর্মের সুবিধা যেমন এতে নিশ্চিত হয়, সেই সঙ্গে রিইউজ করা ফেব্রিকের ওপর ব্যবহারজনিত চাপও কম পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে নিটেড ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়েছে।
এই পুরো কালেকশনের মধ্য দিয়ে টেকসই ফ্যাশনের ব্যাপারে রোজিনার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছে। তিনি এই কাপড় সুলভে সংগ্রহ করে আপসাইকেল করে সেগুলোর আবেদন বাড়িয়েছেন, নিপুণ ডিজাইনে উপস্থাপন করেছেন নতুন রূপে। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে উৎসাহিত হয়ে অন্যরাও এভাবে টেকসই ফ্যাশন নিয়ে ভাববে বলে তিনি আশা রাখেন। রোজিনা বিশ্বাস করেন যে দেশে টেকসই উৎপাদনে যাঁরা যত মনোযোগী হবেন, তাঁরাই এগিয়ে যাবেন সার্বিক উন্নয়নের পথে। তিনি এ–ও মনে করেন, এই পরিবেশবান্ধব পোশাকগুলো ক্রেতাদের দেবে অন্য রকম পরিতৃপ্তি ও আত্মবিশ্বাস।
ছবি: ডিজাইনারের সৌজন্যে পাওয়া