শিকড় ছাড়া গাছ বাঁচে না। ফিউশনের ফ্যাশনযাত্রা সার্থক হতে হলে তাই শিকড়কেই আগে মজবুত করতে হবে। এই সত্যের দ্যোতনার প্রকাশ ঘটেছে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশে আয়োজিত ‘খাদি: দ্য ফিউচার ফেব্রিক’ শোয়ের দ্বিতীয় দিনের আয়োজনেও। তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে দিনব্যাপী প্রদর্শনীর শেষে খোলা আকাশের নিচে ফ্যাশন শোয়ের শুরুতে এফডিসিবির প্রেসিডেন্ট ডিজাইনার মাহিন খানের বক্তব্যেও এ সুর শোনা যায়।
খাদির আদি ইতিহাস আর উপমহাদেশের মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই বস্ত্রের অথেনটিসিটি বজায় রেখে তাকে ভবিষ্যৎ জয়যাত্রার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর অতীতকে ভালোবেসেই ফিউচার বা ভবিষ্যৎ পূর্ণতা পাওয়ার এক প্রকাশ ছিল এই খাদি উৎসব। আয়োজনটি দেশের সর্বকালের সবচেয়ে গুণী ডিজাইনারদের একজন, অকালপ্রয়াত এমদাদ হকের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়েছে। এফডিসিবির এই প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্টের সম্মানে ভেন্যুর প্রবেশমুখেই রাখা ছিল তাঁর প্রতিকৃতিসহ স্ট্যান্ড।
দ্বিতীয় সন্ধ্যার শুরুতেই ছিল ডিজাইনার শৈবাল সাহার সংগ্রহ। প্রাকৃতিক নীলের ছোঁয়ায় এই সংগ্রহে খাদির পোশাকের স্টাইলিংয়ে দেওয়া হয় জেনজি ভাইব।
ছিল ছোট স্কার্ট, ওভারসাইজড এ লাইন কাটের ড্রেস। অনেক পোশাকেই প্রিন্ট আর টাই-ডাইয়ের ব্যবহার দেখা গেল। ছেলেরা পরেছে স্ট্রেট জ্যাকেট আর ফিটেড ট্রাউজার্স; ইনার শার্টের সঙ্গে।
এফডিসিবির প্রেসিডেন্ট মাহিন খানের সংগ্রহের পোশাকের একটা অংশ ছিল দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের থিমে তৈরি। পোশাকের বিভিন্ন জায়গায় মন্দিরের থিমের বিভিন্ন মোটিফ। রাধাকৃষ্ণের অবতার সহযোগে সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় পুরো ব্যাপার বোঝা গেল।
হেডপিস, লেয়ারিং, এক্সটেনশন, পাফড ডিটেইলস আর কয়েক ধাপ বা টিয়ারের ব্যবহার দেখা গেল পোশাকে। কালার প্যালেটে ছিল সফট টোনের বেজ, ধূসর আর মেটে রং। শো-স্টপার রুনা খানের পোশাক ছিল আবার একেবারেই আলাদা রঙের। উজ্জ্বল নীল শাড়ি আর ম্যাচিং স্টাইলিশ জ্যাকেট পরেন তিনি।
এরপর ছিল ভারতের ডিজাইনার চার্লির সংগ্রহ। দু-তিনটি পোশাক ছাড়া আর্থি বা মেটে টোনেই রাঙিয়েছেন এই তরুণ ডিজাইনার তাঁর খাদি বস্ত্র। এ লাইন কাটের কুর্তি বা এক ছাঁটের কামিজের মতো ড্রেস দেখা গেল।
পাফড স্লিভস থেকে শুরু করে অফ দ্য শোল্ডার—সবই ছিল। ছিল ক্রপ টপ আর লম্বা স্কার্ট কম্বো। লেয়ারিং হয়েছে এখানেও খাদি জ্যাকেটে। ছেলেদের জন্য ছিল দেখা গেল খাদি জ্যাকেট, পাঞ্জাবি আর কোটি।
সৃষ্টিশীল ডিজাইনার শাহরুখ আমিনের সাদা-সোনালি সংগ্রহের র্যাম্প ওয়াকে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা লাল স্প্ল্যাশ দিয়েছে সতেজ আমেজ। বড় লাল ফুলের প্যাটার্ন, ছেলেদের পোশাকে মাথা ঢাকা স্কার্ফের পর শো-স্টপার অভিনেত্রী অপি করিমের শাড়িতে লাল পুরোপুরি প্রাধান্য পায়।
তবে সব মিলে ঐতিহ্যবাহী ঘরানাতেই ডিজাইন করেছেন শাহরুখ এই সংগ্রহের পোশাক। পুরো র্যাম্পওয়াকের সময়টুকু সামনে এসে সুরে ডুবিয়ে রেখেছিলেন গায়ক স্বপ্নিল সজীব।
এরপর ব্যতিক্রমী কাজ নিয়ে ডিজাইনার কুহু প্লামন্দনের কালেকশনের শুরুতেই তুলিতে লেখা ফ্রিডম আর সমার্থক সব ইংরেজি শব্দসংবলিত পোশাকের সঙ্গে একটি বস্ত্রখণ্ড পেছনে মেলে এলেন মডেল। তাঁর পথ ধরে আসা বাকি মডেলদের পোশাকের ডিজাইনে পপ আর্টের ছাপ।
অ্যাসিমেট্রিক কাট আর উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার সব পোশাকেই। প্রজাপতির থিমও দেখা গেল ফ্লোউই প্যাটার্ন আর রঙের ব্যবহারে।
ডিজাইনার নওশীন খায়ের ট্র্যাডিশনাল মোটিফের বুনন আর পেইন্টের শাড়ির লুকে নানা রঙের খাদি টপ আর জ্যাকেট যোগ করেছেন। প্যান্ট টপের সঙ্গে খাদি শালের লেয়ারও দেখা গেছে। ছেলেদের পোশাকে সাদামাটা কুর্তা-পাজামা আর পাঞ্জাবি।
ভারতের ডিজাইনার সায়ন্তন সরকারের কালেকশনে খাদিতে নানা রঙের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। ছিল নারীদের সব ধরনের পোশাক। ছেলেদের স্যুটে কাট আর প্যাটার্নে বৈচিত্র্য। মেয়েদের পোশাকে র্যাপড স্টাইল আর কন্ট্রাস্ট লেয়ারিং চোখে পড়েছে।
রংচঙে কালেকশনের পরে যেন চোখে আরাম দিয়েছে ডিজাইনার লিপি খন্দকারের পোশাক। খাদিকে একেবারে খাদির মতো করেই সবার সামনে এনেছেন তিনি। খাদির আদি ও অকৃত্রিম সিগনেচার রং রেখেই কাট আর প্যাটার্নে বৈচিত্র্য রেখেছেন লিপি খন্দকার। পরিমিত এমবেলিশমেন্টে কড়ির মতো অনুষঙ্গ ব্যবহার হয়েছে। শাড়ি আর পশ্চিমা আউটফিট—সবকিছুতেই সমসাময়িক ফিউশনের আমেজ এমনভাবে আনা হয়েছে যেন খাদিকে খাদি বলে চিনতে শেখে নতুন প্রজন্ম। শো-স্টপার, পপ ডিভা মেহরীনের আউটফিট আভিজাত্যপূর্ণ। সঙ্গে তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান সন্ধ্যাকে মাতিয়ে দেয়।
বরিষ্ঠ ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ানের থিমটি এখানে খুবই কৌতূহল জাগিয়েছে র্যাম্পে মডেলরা আসার আগেই। তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় রংতুলিতে প্রজাপতি আঁকার মতো করে ডিজাইন করেছেন তিনি এই সংগ্রহের পোশাকে। বহুবর্ণিল চিত্রকর্মের মতোই মনে হচ্ছিল আউটফিটগুলোকে। লাল, সবুজ ইত্যাদি রঙের ব্যবহার খাদিকে দিয়েছে প্রাণবন্ত লুক।
ছবি: হাল ফ্যাশন