টেকসই ওয়ার্কওয়্যার হিসেবে ডেনিমের যাত্রা শুরু হলেও আজ বিশ্বব্যাপী সময়োপযোগী ফ্যাশনে আইকনিক মেটেরিয়াল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ওয়ার্কওয়্যারের উৎস হিসেবে উনিশ শতকে ডেনিমের জন্ম। শ্রমিক ও খনিশ্রমিকদের জন্য মোটা টেকসই কাজের পোশাক হিসেবে এর উদ্ভব। কাপড়ের স্থায়িত্ব, ব্যবহার উপযোগিতা আর টেকসই হওয়ার কারণে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত ‘সার্জ ডি নিমস’ বা ‘ডেনিম দে নিমস’ (ফরাসি শহর নিমস থেকে) নামে পরিচিত। এই কাপড়কে শেষ পর্যন্ত ছোট করে ‘ডেনিম’ বলা হয়ে থাকে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি ডেনিমের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়। হলিউড মুভি এবং পপ আইকন যেমন মারলন ব্র্যান্ডো ও জেমস ডিন ডেনিমের বিদ্রোহী ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছেন। একে তারুণ্য ও অসংগতির প্রতীক করে তুলেছেন। যেহেতু ডেনিম ওয়ার্কওয়্যার থেকে নৈমিত্তিক ফ্যাশনে রূপান্তরিত হয়েছে, লিভাইস ও র্যাংলারের মতো ব্র্যান্ডগুলো মানসম্পন্ন জিনসের সমার্থক হয়ে উঠেছে। অবশ্য ডেনিমের উদ্ভাবক আসলে লিভাইস। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, কাপড়ের নাম ডেনিম হলেও এই কাপড় দিয়ে তৈরি পাঁচ পকেটের প্যান্টকে জিনস বলা হয়। এই প্যান্টেরও আবিষ্কারক লিভাইস।
ফ্যাশন ও এর বাইরে বিশ শতকের শেষের দিকে ডেনিম একটি রূপান্তরমূলক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। ডিজাইনার এবং ফ্যাশন হাউসগুলো ডেনিমকে হাই অ্যান্ড কালেকশনে অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করে। বস্তুত ১৯৮০ সালে আরমানি প্রথম ডেনিম নিয়ে কাজ করেন। তিনি জিনস তৈরি করে তখনকার হার্টথ্রব তারকা ব্রুক শিল্ডকে মডেল করে এই জিনসের প্রচার করেন। এরপর বলতে গেলে জাতে ওঠে ডেনিম। অন্য ডিজাইনরারও ডেনিম নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। সাধারণ কাপড় থেকে ফ্যাশন স্টেটমেন্টে উন্নীত হয় জিনস। ক্রমেই জিনস নিয়ে প্রচুর নিরীক্ষা হতে থাকে। নানা ধরনের ওয়াশ ও ভ্যালু অ্যাডেড জিনস (অ্যাসিড ওয়াশ, ডিস্ট্রেসড ও অলংকৃত করা) জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। প্রাথমিকভাবে জিন্স তৈরি হলেও পরে ডেনিম জ্যাকেট, স্কার্ট, শার্টসহ নানা ধরনের পোশাক ও অন্যান্য পণ্য তৈরি হতে থাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থায়িত্ব ও উদ্ভাবন ডেনিম শিল্পে উল্লেখযোগ্য চালক হয়ে উঠেছে। ভোক্তারা পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়ার সঙ্গে, ডেনিম নির্মাতারাও পরিবেশবান্ধব বিষয়গুলোকে গ্রহণ করছে। টেকসই ডেনিম উৎপাদন কৌশলের মধ্যে রয়েছে অর্গানিক তুলা ব্যবহার, জলের ব্যবহার কমানো, ডেনিম ফাইবারের পুনর্ব্যবহার করা ও নৈতিক উত্পাদনপ্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন।
এ ছাড়া প্রযুক্তির অগ্রগতি ডেনিম উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। কোম্পানিগুলো জল ও রাসায়নিকের ব্যবহার কমাতে লেজার প্রযুক্তি এবং ওজোন ওয়াশের মতো নতুন রং করার কৌশল নিয়ে পরীক্ষা করছে। ডেনিম পোশাকে স্মার্ট টেক্সটাইল ও পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির একীকরণেও সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। এর ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, আর্দ্রতা ধরে রাখার ও ইন্টারেকটিভ কার্যকারিতা সম্পন্ন ডেনিম কাপড় অচিরেই সুলভ হয়ে উঠবে।
ওয়ার্কওয়্যার হিসেবে ডেনিমের সূচনা হলেও সেখান থেকে অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়েছে এই কাপড়। কেবল জিনসে আটকে না থেকে বৈচিত্র্যময় পোশাক আর অনুষঙ্গ তৈরি হচ্ছে ডেনিম দিয়ে। আর একেবারে সাধারণের গণ্ডি থেকে হাইস্ট্রিট ফ্যাশনের অংশ হয়ে গেছে ডেনিম।
বিশ্বজুড়ে ডেনিম এখন সব বয়সীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত কাপড়ে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে জিনস আছে আবার সবচেয়ে এগিয়ে। প্রতিদিনই বাড়বে এর জনপ্রিয়তা। বিশ্বজুড়ে সবার ওয়ার্ডরোবে জিনস ও ডেনিমের পোশাকের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয়, ডেনিম পরিবর্তনশীল ফ্যাশন টেন্ড্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে সব সময়ের প্রয়োজনীয় কাপড়ে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে নানা উদ্ভাবন এর জনপ্রিয়তাকে কেবল বাড়িয়েই চলেছে।
টেকসই ফ্যাশন, প্রযুক্তির নতুনতর সংযোজন আর পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা, পুনব্যবহারের প্রয়াস ডেনিমকে যে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত ফ্যাশন মেটেরিয়ালে পরিণত করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক: ডিজাইনার ও সত্বাধিকারী ‘সিগনেচার জিনস’
ছবি: হাল ফ্যাশন