আমার ঢাকা। ফেসবুকভিত্তিক পপ আপ স্টোর কেয়ার অব ঢাকার আসন্ন অফলাইন প্রদর্শনী অটাম ক্লাউডসের থিম এটিই রাখা হয়েছে। আসলে ঢাকা তো আমারই। এই আমি মানে আমি আপনি সবাই। দেশের সব প্রান্ত থেকে আসা মানুষকে যেমন বুড়িগঙ্গা বিধৌত এই উদার শহরকে আপন করে নিয়েছে, তেমনি পরিযায়ীদের সংস্কৃতি যুগযুগান্তর ধরে ঢাকাকে করেছে ঋদ্ধ।
তাই আমার ঢাকা বললে সবাই আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি। ঢাকার রাস্তার টুকরা সব প্রতিচ্ছবি আর ঘটনাপ্রবাহ, ঢাকার ঐতিহাসিক ও আধুনিক সব স্থাপত্য, উন্নয়নের ল্যান্ডমার্ক আর মেট্রোরেলের মতো যাপিত জীবনের নতুন সংযোজন, ঢাকার নিজস্ব খাট্টামিঠা বচন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প—এসবই জড়িয়ে আছে সে আবেগের আখ্যানে।
প্রথমেই আসা যাক ফাতেমা তুজ জোহরা নুভিয়ার অনন্য উদ্যোগ ‘খাদি বাই নুভিয়ার’ কথায়। প্রথমে ঐতিহ্যবাহী খাদি নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন সব ধরনের কাপড়েই বৈচিত্র্যময় কাজ করেন নুভিয়া। আমার ঢাকা থিমে তাঁকে সবার আগে টেনেছে ঢাকার অবিসংবাদিত বই স্বর্গ নীলক্ষেত। নুভিয়ার বয়ানে, প্রিয় নীলক্ষেত আর নীলক্ষেতের সারি সারি বইয়ের দোকান। এই বইয়ের দোকানগুলোর সঙ্গে আমাদের যেন আত্মার যোগ। নতুন–পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণ আর এ এলাকার আশপাশের শাপলা চত্বর, দোয়েল চত্বর, টিএসসিতে বন্ধুদের সঙ্গে রিকশায় ঘোরাঘুরি—এসবই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সবার মধুর সময়ের দিনলিপি। এ সময়টুকুকে শাড়ির ক্যানভাসে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়ে খাদি তৈরি করেছে ‘প্রিয় নীলক্ষেত’ শাড়িটি।
ঢাকার নিজস্ব ডায়ালেক্ট বা ঢাকাইয়া বচন ছাড়া এ শহরকে ভাবাই যায় না। চলতি পথে কানে ভেসে আসা টুকরোকথন, বন্ধুদের আড্ডার ট্রেন্ডি ডায়ালগ আর আটপৌরে জীবনের কথোপকথন যা–ই হোক না কেন, ঢাকাইয়া বচনের খাট্টামিঠায় তা হয় আরও একটু স্বাদু। আর মুসাররাত নওশাবার পোশাকের উদ্যোগ ঋতির ‘আমার ঢাকা’ থিমে বানানো ‘The ঢাকা talks’ শাড়ির অনুপ্রেরণা এখান থেকেই এসেছে। ঢাকাইয়া বচন নিয়ে শাড়ির ক্যানভাসে কাজ করার সৃজনশীল চিন্তা আসলেই প্রশংসনীয়। শাড়ি জুড়ে কী কী ডায়ালগ আছে, তা জানতে হলে আসতে হবে প্রদর্শনীতে।
দিশাজ রোড ব্লক বহুদিন ধরেই মজার আর অভাবনীয় সব থিমে ব্লক করে থাকে শাড়ি, জামা, ব্লাউজ বা কুর্তিপিসে। রংতুলি আর ডিজিটাল প্রিন্টেরও আছে বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ। যাপিত জীবনের চশমা, বিড়াল, মাছের কাঁটা, দাবার ঘুঁটি, তালাচাবি, ফুল, পাতা, বৃষ্টি, হাতি তো আছেই, বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাস, কমিকস আর চলচ্চিত্রের নায়ক–নায়িকা আর চরিত্রও ফুটে ওঠে এ উদ্যোগের কর্ণধার সায়কা শাহরিন দিশার ডিজাইনে। তিনি বলেন, পুরোনো ঢাকার নাম এলেই সঙ্গে লালবাগের কেল্লা, হোসেনি দালান, বাহাদুর শাহ পার্ক—এসব স্থাপত্যের নামও আসতেই হবে। আর তাই তিনি ‘আমার ঢাকা’ সিরিজে কুর্তি ডিজাইন করেছেন পুরোনো ঢাকার এসব স্থান নিয়ে।
সানজিদা হক সারার উদ্যোগ কটন রুটসে দেশি শাড়ির সমারোহ রয়েছে ভরপুর। খাদি সিল্ক, কোরা, সুতি, সেমি মসলিনসহ বিভিন্ন ফেব্রিকের ওপরে চমৎকার কাজ করেছেন তিনি এবারের সংগ্রহ সাজাতে। এ ছাড়া জামদানি তো আছেই। ঢাকা নিয়ে যত গান আছে, তার মধে৵ উল্লেখযোগ্য ‘এ শহর জাদুর শহর’, ‘প্রাণের শহর ঢাকা রে’। আমাদের সবার প্রিয় ঢাকা। চিরকুটের এই গান শুনে হৃদয় আন্দোলিত হয় না এমন ঢাকাবাসী কি আছেন! সবার প্রিয় এ গান তাই শাড়ির ক্যানভাসে তুলে ধরেছে কটন রুটস।
ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে মূলত নিজস্ব ইলাস্ট্রেশন বা আঁকিবুকি প্রিন্ট করা হয় আরবান ভোগের শাড়ি আর সালোয়ার–কামিজে। তাঁদের ‘আমার ঢাকা’ থিমের শাড়িটি তৈরির পেছনে মূল অনুপ্রেরণা নিয়ে বললেন, আরবান ভোগের স্বত্বাধিকারী সুমাইয়া আরজু। তাঁর বয়ানে ঢাকার দর্শনীয় স্থাপনা ও একই সঙ্গে পুরোনো ঢাকার জীবন যাপন তাঁকে উদ্দীপ্ত করে। শাড়িটির জমিনে রাখা হয়েছে পুরোনো ঢাকার স্থাপত্য ও বিদ্যুতের তারের ওপর কাক বসে থাকার চিত্র। আঁচলে রয়েছে ঢাকার দর্শনীয় স্থাপনা—আহসান মঞ্জিল, দোয়েল চত্বর, তিন নেতার মাজার, শহীদ মিনার, হাতিরঝিল ও মেট্রোরেল।
উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী কলমকারি ফেব্রিককে শাড়ির বাইরে এনে ট্রেন্ডি আউটফিটের ম্যাটেরিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সুতলি’র কর্ণধার রিফাত লোপা। তাঁর কথায়, সুতলির চোখে ঢাকা একই সঙ্গে ধোঁয়া আর রঙের শহর। তাই তো সুতলির পোশাকে ধোঁয়ার কালো রঙে ঢাকা এই ঢাকা শহরের মধে৵ রঙিন এ জনপদের হরেক রঙের প্যাচওয়ার্ক। এর মধে৵ই আছে রিকশা পেইন্ট মোটিফের পকেট। প্যান্টে আছে ফুলেল মোটিফ। কংক্রিটের ঢাকার মধে৵ যেখানে একবিন্দু মাটি আছে, সেখানেই গাছে গাছে ফুল ফুটুক—এটিই সুতলির স্বপ্ন, জানালেন লোপা।
সুরঞ্জনা উদ্যোগের প্রাণভোমরা নূর নাহার তৃপ্তি আমার ঢাকা থিমের কথা বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে গেলেন যেন। বললেন, ঢাকাকে বরাবরই আমার কাছে অসংখ্য যানবাহনে ঠাসা চলমান ছুটতে থাকা জীবন মনে হয়েছে। আসলেই তো ঢাকা শুধু ছুটছে। জ্যামের বদৌলতে থামতে হয় বলে চোখ মেলে দেখা হয় ঠাসবুনোটের বসতবাড়ি, নতুন আর পুরোনো স্থাপনা, বাজার আর মানুষ। তৃপ্তি বলেন, প্রতিদিন ভাবনারা এ শহর ছাড়তে চাইলেও কী এক অমোঘ টানে এ জাদুর শহরে আটকা পড়ে আছে ভেজা কাক হয়ে থাকা এ মন। এমন একটি ভাবনা থেকেই সুরঞ্জনা তৈরি করেছে এই দারুণ শাড়ি।
ঢাকা যত দিন থাকবে, ঢাকার সঙ্গে জামদানি নামটিও বোধ হয় তত দিন থাকবে। জামদানি আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক। আর এ অনন্য বস্ত্রের সূতিকাগার এই ঢাকা। সাধারণত শাড়ি তৈরি হয় জামদানি দিয়ে। কিন্তু শুধু এক পোশাকেই এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি আটকে থাকবে কেন! সেই ভাবনা থেকে জামদানি কাপড় দিয়ে অবনীর স্বত্বাধিকারী নাজিয়া বিনতে হারুন ডিজাইন করেন কটি, শ্রাগ, সালোয়ার-কামিজসহ নানা রকমের ঐতিহ্যবাহী ও ট্রেন্ডি পোশাক।
প্রচলিত ধারা ভেঙে দেশি পোশাকের অনলাইন উদ্যোগগুলোর মধ্যে এক্সক্লুসিভভাবে বটম নিয়ে কাজ করেন সরলার স্বত্বাধিকারী মানসুরা স্পৃ্হা। সরলার বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের প্যান্ট, ট্রাউজার, স্কার্ট, পালাজ্জো আর স্ক্যান্টের সংগ্রহ রীতিমতো অবাক করা। আমার ঢাকা থিমে করা সরলার স্কার্টটিতে আছে ঢাকা শহরের অলিগলিতে আমাদের প্রতিদিনের ছোটগল্প। আছেন ফুচকাওয়ালা মামা, আছে হিমু-রুপার মেট্রোরেল দেখতে যাওয়া, আছে ব্যস্ত ফার্মগেট অথবা টিএসসির আড্ডা। টুকরো টুকরো ঢাকাকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে এই আবেগপ্রবণ করে তোলা পোশাকটি।
রুবাইয়াত চৌধুরীর পোশাক ও হোম ডেকরের উদ্যোগ ‘চৌধুরীস’। রুবাইয়াত বললেন, আমার ঢাকা থিমে বানানো রাগের পাশাপাশি খুব পছন্দের কিছু জায়গা যেমন শাহবাগ, নীলক্ষেত, হাতিরঝিল, চায়ের টং আর প্রিয় ঢাকার কিছু বাহন রিকশা, সিএনজি আর দোতলা বাস—সবকিছু মিলিয়ে আমার ঢাকা থিমে করা তাঁদের আরেকটি কাজ লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে। এ ছাড়া চৌধুরীস থাকবে তাদের সিগনেচার জামদানি শাড়ি ও মগের যুগলবন্দী নিয়ে।
‘কেয়ার অব ঢাকা’ একটি ফেসবুকভিত্তিক পপআপ স্টোর। তারা ৬ থেকে ৭ অক্টোবর ২০২৩–এ আয়োজন করছে তাদের দ্বিতীয় অফলাইন প্রদর্শনী অটাম ক্লাউডস। এবার ৩০টি উদ্যোগ অংশ নিচ্ছে এই আয়োজনে। তারা প্রত্যেকে তৈরি করেছে এমন একেকটি বিশেষ পণ্য, যা প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকাকে।
এই অভিনব উদ্যোগের আদ্যোপান্ত জানতে হলে চোখ রাখতে হবে কেয়ার অব ঢাকার পেজে এবং আসতে হবে অটাম ক্লাউডস বাই কেয়ার অব ঢাকা মেলায়, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাইডাস সেন্টারে। উল্লেখ্য, এই চমৎকার আয়োজনে কেয়ার অব ঢাকার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে আছে বাংলাদেশের প্রথম ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ওয়েব পোর্টাল ‘হাল ফ্যাশন’।
ছবিঃ কেয়ার অব ঢাকা ও উদ্যোক্তাদের ফেসবুক পেইজ