রুবি গজনবীর অনুপস্থিতিতে জৌলুশ হারিয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রং
শেয়ার করুন
ফলো করুন

শেখ সাইফুর রহমান

সৈয়দা রুবি গজনবী। আমাদের রুবি আপা। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সেই স্মৃতি চির অম্লান। ঠিক কবে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, মনে নেই সেই দিনক্ষণ। তখনো সেলফোন জমানা শুরু হয়নি। আমি তখন দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করি। মতিঝিলে অফিস। সবে শুরু করেছি বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। নতুন নতুন মানুষ খুঁজে বের করছি, যাঁরা তখন ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখছেন নানাভাবে। তো এই খোঁজার প্রক্রিয়ায় পেয়ে গেলাম তাঁর নম্বর। অফিসের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করে অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে গেলাম তাঁর অফিসে। তার আগে অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে, স্টাডি করে তবেই গিয়েছিলাম।

সৈয়দা রুবি গজনবী। আমাদের রুবি আপা
সৈয়দা রুবি গজনবী। আমাদের রুবি আপা

তখন অরণ্যের অফিস ছিল ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে। ইদানীং আমার নিয়মিত যাওয়া হয় ওই রাস্তায়। প্রতিদিনই দেখি সেই বাড়িটা। এখন বহুতলে বদলে যায়নি। দোতলায় বসতেন তিনি। নিচে ছিল তাঁর কারখানা। সামনের চেয়ারে বসলাম। অবশ্যই তাঁর অনুমতিক্রমে।

তারপর জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে বললেন, বলো কী জানতে চাও? সেদিন অনেকক্ষণ কথা হলো আমাদের। আপাত রাশভারী মানুষটির অন্য রূপও টের পেলাম। অনুভব করলাম তাঁর স্নেহের উষ্ণতা। এরপর নানা সময়ে কথা হয়েছে। তবে একবার একটা রিপোর্টের জন্য তাঁর কাছ থেকে কিছু বিষয় জানা দরকার। এসব ক্ষেত্রে আমি গিয়েই কথা বলি। কিন্তু সেবার আমার হাতে একদমই সময় ছিল না। ফোনে আমার গলা শুনে তাঁর চিরাচরিত ভঙ্গিতে বললেন বলো?

বললাম, আপনার কাছ থেকে আমার কিছু বিষয় জানা দরকার।
 
বললেন, চলে এসো।
 
বললাম, আপা হাতে সময় নেই। আজকেই লেখা জমা দিতে হবে। তাই যদি একটু ফোনে বলতেন।
 
হাসতে হাসতে বললেন: তোমরা সাংবাদিকেরা পারোও বটে। বুঝলাম সেখানেও আছে তাঁর সেই স্নেহ। 

বিজ্ঞাপন

সেটা মনে হয় ২০০০ সাল হবে। অরণ্যের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রাকৃতিক রং নিয়ে এক পৃষ্ঠার আয়োজন করেছিলাম। দারুণ খুশি হয়েছিলেন আপা। সেটাই ছিল বোধ করি আমার কারুশিল্প পরিষদে পা রাখার অনুঘটক।
 
বললে অত্যুক্তি হবে না তিনিই আমাকে এই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আস্তে আস্তে কাজ শিখিয়েছেন। দায়িত্ব দিয়েছেন। তদারকিও করেছেন, যাতে ঠিকভাবে আমি দায়িত্ব পালন করতে পারি। তারপর নির্বাচনে বিভিন্ন পদে আমাকে রেখেছেন। তাঁকে সত্যিকারের মেন্টর বললে অত্যুক্তি হবে না একটুও। তাঁর উৎসাহে যে পরিবারের সদস্য হয়েছিলাম, সেই পরিবারে তাঁর অনুপস্থিতিতেও আছি তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে।

নতুনদের কাজে আগ্রহী করে তুলতে তিনি থাকতেন সদা সচেষ্ট
নতুনদের কাজে আগ্রহী করে তুলতে তিনি থাকতেন সদা সচেষ্ট

কাজ দিয়ে যেমন নির্ভর করতেন, তেমনি কাজটা যাতে আমি ঠিকঠাক করতে পারি, তাই মাঝেমধ্যেই ফোন করে খোঁজ নিতেন। তাগিদ দিতেন। অধিকার নিয়ে ফোন করে বলতেন, এটা কী হয়েছে? মেইল দিয়েছ? অ্যানুয়াল রিপোর্টটা তৈরি করে দিয়ো।নতুনদের কাজে আগ্রহী করে তুলতে তিনি থাকতেন সদা সচেষ্ট। যেকোনো ইভেন্টে তিনি চাইতেন নতুনরা আসুক। মনে আছে ২০০৯ সালে আমরা ঢাকায় ব্যাকস্ট্র্যাপ লুম কনফারেন্স করেছিলাম। এমন উদ্যোগ এর আগে আর কোথাও নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। সেবার প্রদর্শনীর সঙ্গে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন ব্যাকস্ট্র্যাপ লুমের (কোমরতাঁতের) বয়নশিল্পীরা। সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভোট অব থ্যাংকস দেওয়ার দায়িত্ব তিনি আমাকে দেন। আমি সেটা লিখি। তারপর তিনি পড়ে ঠিকঠাক করে দেন। তারপর আমি ভোট অব থ্যাংকস দিই। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ফলে জড়তা থাকা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু তিনি অভয় দিয়ে সেই জড়তা কাটাতে সহায়তা করেন। কেবল সেটাই নয়, ভোট অব থ্যাংকস দেওয়া শেষ হলে তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেন, খুব ভালো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

২০০৭ সালের জুন বা জুলাই হবে। একদিন অফিসে যাচ্ছি হঠাৎ আপার ফোন। তুমি কোথায়? তোমার পাসপোর্ট নিয়ে এখনই আমার অফিসে এসো। কিন্তু পাসপোর্ট কেন, সেটা বললেন না। আমি মাঝরাস্তা থেকে ফিরে বাসায় গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে তাঁর অফিসে গেলাম।
 
ঢুকতেই বললেন, বসো ছেলে। আর শোনো তোমাকে আগামী সপ্তাহে জার্মানি যেতে হবে।
 
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কোনো প্রস্তুতি নেই। তার ওপর অফিসের ছুটির বিষয় আছে। যাহোক, পাসপোর্ট নিয়ে তিনি তখন ইউরোপিয়ান ক্র্যাফট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বার্নড রোটারকে মেইল করে চিঠি আনালেন। সেখানে পাসপোর্ট নম্বর ভুল ছিল। আবার ঠিক করে পাঠালেন রোটার। ফোনে তিনি টিকিট বুক করালেন। বলে দিলেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে। তারপর বললেন, এখনই গিয়ে ফরম নাও। জার্মান অ্যাম্বাসি তখন গুলশান অ্যাভিনিউতে। সেখানে গিয়ে ফরম নেওয়ার সময় কাউন্টারের ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি কবে যেতে চান। আমি তারিখ বলায় তিনি বললেন, কাল সকালেই তো জমা দিতে হবে।


 
সেখান থেকে দে ছুট। গেলাম ইনস্যুরেন্স করাতে। তারপর অফিসে গিয়ে সব বলার পর আমার বিভাগীয় প্রধান অফিসের চিঠি ম্যানেজ করে দিলেন। পরদিন সকালে গিয়ে ভিসা ফরম জমা দিলাম। বিকেলে পেলাম ভিসা। তারপর গেলাম জার্মানি। মাইঞ্জে গিয়ে রোটারের আতিথ্য নিলাম। সম্প্রতি তিনি মহাকালের অতিথি হয়েছেন।
 
এই ট্যুরটা হয় পুরোপুরি রুবি আপার জন্য। এই অভিজ্ঞতা এসে তাঁকে বলতে হয়েছে। লিখিত রিপোর্টও দিতে হয়েছে। এভাবেই নিয়মিত শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। প্রতি পদক্ষেপে।  
 
ইউরো–এশিয়া গ্রান্টের অধীনে একটা কাজ করছিল বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ। সেখানে একটা ট্যুর প্রোগ্রামও ছিল। সাত দিনের জন্য যেতে হবে মাইঞ্জ ও বার্লিনে। এই সফরেই আমাকে পাঠানো হয়।

তিনি ছিলেন সদা তৎপর এক কারুশিল্প অনুরাগী। তাঁর মধ্যে দারুণ জেদ কাজ করত। দুটি উদাহরণেই সেটা স্পষ্ট হবে। শেষেরটা আগে বলা যাক। ১৯৯৮ সাল থেকে ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শিলু আবেদ ট্রাস্টের আর্থিক পৃষ্ঠপোষণায় বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ প্রতিবছর প্রদান করে আসছিল শিলু আবেদ শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার। এই পুরস্কারকে পরে আজীবন সম্মাননা করা হয়। কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে ২০১৬ সালে শিলু আবেদ ট্রাস্ট আর্থিক পৃষ্ঠপোষণা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এই পুরস্কার প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ঠিক সেই সময়ে তিনি তাঁদের পারিবারিক ট্রাস্টকে (যেটা তাঁর বাবা প্রয়াত এ এফ মুজিবুর রহমানের নামে) রাজি করিয়ে পৃষ্ঠপোষণার ব্যবস্থা করেন। 

রুবি আপার অগ্রবর্তী ভূমিকায় সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে জামদানি হয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য।
রুবি আপার অগ্রবর্তী ভূমিকায় সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে জামদানি হয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য।

এবার আসি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। সম্ভবত ২০০৯ সাল। সেবার মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিলের কংগ্রেস। সেখান থেকে ফিরে তিনি জরুরি মিটিং ডাকার ব্যবস্থা করলেন। আলোচনার বিষয় জামদানির ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হওয়া না–হওয়া। তিনি জেনে এসেছেন সেখানকার কোনো একটা কাপড়কে জামদানি বলে সেটার জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখন কর্মপ্রক্রিয়া কী হবে, সেটা নিয়েই আলোচনা হলো। তিনি থাকলেন পুরোভাগে। বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী মহলে যোগাযোগ শুরু হলো। ব্র্যাকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি স্টাডি করা হলো। তারপর সরকারের নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করানো হলো। পুরো বিষয়টা তিনি করলেন সামনে থেকে। যাকে বলে লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট। আর জয়ও ছিনিয়ে আনলেন। জামদানি হলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। 

যথার্থ শুদ্ধতাবাদী বলেই কোনো ধরনের স্খলন তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বাংলাদেশের হেরিটেজ টেক্সটাইল বিষয়ে তিনি সব সময়ই থাকতেন সচেতন। অনেক কিছুই শেখা হয়েছে তাঁর কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে আমার বা আমাদের দ্বিমত হতো না, তা নয়। তবে তাঁকে বোঝালে তিনি ঠিকই বুঝতেন। শেষে এসে তাঁর মূল কাজের কথায় আসি। ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামী ও সমাজ সংস্কারক কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীনতার পর ভারতীয় হস্তশিল্প ও নাট্যকলাকে পুনরুজ্জীবিত করতে তাঁর নিরলস প্রয়াস ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর সাহচর্যে প্রাণিত রুবি গজনবী বাংলাদেশের কারুশিল্পের পুনরুজ্জীবনে ব্রতী হন। ১৯৮৫ সালে প্রয়াত পটুয়া কামরুল হাসানের নেতৃত্বে রুবি গজনবী ও তাঁর মতো সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ।

রুবি গজনবীর অনুপস্থিতিতে যেন থমকে গেছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রঙের কার্যক্রম
রুবি গজনবীর অনুপস্থিতিতে যেন থমকে গেছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রঙের কার্যক্রম

তবে তারও আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর প্রতিষ্ঠান অরণ্য ক্র্যাফটস। এই প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই নিয়োজিত ছিল বাংলাদেশে প্রাকৃতিক রঙের পুনরুজ্জীবন ও অনুশীলনে। খুঁজে বের করেছেন নতুন নতুন রং। আমৃত্যু তিনি চালিয়ে গেছেন এই প্রয়াস। তিনি ছিলে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিলের ন্যাচারাল ডাই কমিশনের চেয়ারপারসন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর অনুপস্থিতিতে যেন থমকে গেছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রঙের কার্যক্রম।বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের কারুশিল্প ও প্রাকৃতিক রং দুটো বিষয়কেই তিনি আজীবন ভালোবেসে গেছেন। আমরা যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছি, তারাও সেই পথে হাঁটার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে তাঁর নিদারুণ শূন্যতা। 

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩: ৩০
বিজ্ঞাপন