আজ ২৫শে বৈশাখ, কবিগুরুর জন্মজয়ন্তীতে সাহিত্য, গণিত -বিজ্ঞানের বোধ আর জীবনদর্শনের পাশাপাশি ফ্যাশনের আতসী কাঁচ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখে সে কলমচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক এখানে।
আর দশজনের মতো জাতীয় সংগীতের রচয়িতা হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর পাঠ্য হিসেবে তাঁর ছেলেবেলার কথা পড়তে হয়েছে। করতে হয়েছে ফটিক বা হৈমন্তীর চরিত্রের বিশ্লেষণ। আবার অন্যদের মতো পোস্টমাস্টারের সঙ্গে রতনের আবার দেখা হলো কি না, সেটা নিয়েও উতলা হয়েছি। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের নানা গান এবং বিটিভিতে পঁচিশে বৈশাখে তাঁর লেখা কোনো গল্পের নাট্যরূপ আমাদের শৈশব বা ‘বালাই কাল’ কৈশোরকে রাঙিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা এবং পতিসরে তার ক্ষুদ্রঋণের কাজ নিয়ে জানতে পেরেছি।এসব কারণে অন্য অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করার সময় তাঁর সাহিত্যকর্মই আমাদের সামনে বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠে। একসময় আমার মনে হতো, মানবমনের যত ধরনের অবস্থা হতে পারে, তার সব নিয়েই রবি ঠাকুরের গান বা কবিতা আছেই।
গণিত বা বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বপরিচয় এবং লাল উজানি ও বেগনি পারের আলোর রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনাও আমাকে অনেকখানি বিমোহিত করে। প্রথম যখন কনভার্জড অসীম ধারার যোগফল বের করতে শিখি, তখনই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গণিত-বিজ্ঞানের বোধটা টের পাই। আমাদের সময়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর একটি নিবন্ধ স্কুলে পড়তে হতো—কবিতা ও বিজ্ঞান। সেখানেই টের পাই বিজ্ঞানী বা কবি দুজনই আসলে সত্যকেই খোঁজেন। সে জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে ধরা দেয়— ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর। এ যেন হিলবার্টের অসীম কক্ষবিশিষ্ট হোটেলের গল্প। যেখানে একদিন অসীমসংখ্যক শিষ্যকে নিয়ে হাজির হন দুর্বাসা মুনি। আবার যখন ডিজিটাল সিগনেচার নিয়ে কাজ করতে শুরু করি, তখনই টের পাই প্রাইভেট চাবির গুরুত্বটা কী। সেখানেও রবি কবি হাজির হন প্রাইভেসির সবচেয়ে জরুরি তথ্য নিয়ে—ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে!!! মানে, নিজের পাসওয়ার্ড নিজে রক্ষা করো!!!
কিন্তু গেল বছর থেকে নতুন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখার চেষ্টা করছি্। ২০২৩ সালে দৈনিক প্রথম আলোর ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পোর্টাল ‘হালফ্যাশন’-এর সঙ্গে আমার যুক্ততা তৈরি হয়। তখন থেকে এ ভাবনা।
যে লোকটা নিজেই নিজের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে, শব্দ ও সুরে যে বোধ ও ভাবনা প্রকাশ করা যায় না, সেটির জন্য নিজেই ছবি আঁকে তাঁর জীবনাচারণের অন্যান্য অনুষঙ্গে কি অন্যদের উপস্থিতি প্রবল হবে? এই যেমন তাঁর পোশাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো কখনোই মহাত্মা গান্ধীর পোশাককে গ্রহণ করেননি। তাহলে? সাদা চুল ও দাড়ির রবীন্দ্রনাথকে কেমন দেখা যেতো অন্যদের চোখে?
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানে যান। সেখানে তাঁকে দেখেন যুবক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর সাদা চুল মুখের দুই পাশে হালকাভাবে নিচে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি ক্রমাগত নেমে চিবুকের নিচে দাড়ির সঙ্গে মিলেছে। দাড়িও ছেড়ে দেওয়া। বালক বয়সে তাঁকে দেখে আমার মনে হয়ছে তিনি প্রাচ্যের কোন জাদুকর।’ কাওয়াবাতা রবীন্দ্রনাথের পর ইউরোপের বাইরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় কথাসাহিত্যিক।
জার্মানির এক সড়কে কবির একটা ছবি দেখা যায়। ওই লম্বা একেবারে পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত স্পর্শ করা একটি জামা, বলা ভালো জোব্বা। একটু গাঢ় রঙের তবে একদম কালো নয়। পেছনে ম্যাজিশিয়ান বা সুপারম্যানের চাদরের মতো একটি আলোয়ান। এর ভেতরের অংশটি কিন্তু চকচকে, অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল। আমার মতো কানাই মাস্টার হলেও তার ক্ষীণদৃষ্টি ছিল না। শুধু পড়ার সময় চশমা ব্যবহার করতে হতো। ভালো করে খেয়াল করলে চেইনের মধ্যে আটকানো চশমাটা খুঁজে পাবেন। লম্বা করে ঝুলে নেই কিন্ত। সামান্য বাঁকা করে স্টাইলিশভাবেই সেটিকে আটকে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাদা দাড়ি ও চুলের কম্বিনেশন। বাইরের পোশাকে গাঢ় রং বেছে নেওয়ার এটাও কি তবে একটি কারণ?
এই পোশাকের ডিজাইনার কে?
জি, কবি নিজেই!!!
সেটিই হয়তো স্বাভাবিক। কারণ, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ফ্যাশন ও স্টাইল আগে থেকেই ভিন্ন একটি মাত্রা বহন করে। রবীন্দ্রনাথের বাবা বাড়ির মেয়েদের জামা কেটেকুটে জোড়া দিয়ে পরিমার্জন করে নতুন একটা রূপ দিতেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তো বাঙালির শাড়ি পড়ার স্টাইলই বদলে দিয়েছেন। এখন আমাদের মেয়েরা যেমন করে শাড়ি পরে, কোমরে জড়িয়ে, কুচি দিয়ে, একটি লম্বা অংশ ঘুরিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর ফেলা, এটাই ঠাকুরবাড়িতে প্রথম প্রবর্তন করেন জ্ঞাননানন্দিনী দেবী। এমন বাড়ির সবচেয়ে সৃজনশীল লোকটি কি ফ্যাশন থেকে দূরে থাকবেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নিজের জন্য পোশাক ডিজাইন করতেন তখন তিনি জানতেন এই পোশাক মাত্র এক কপিই হবে। এবং সেটা তিনিই পরবেন। কাজে ডিজাইন করার সময় তিনি নিজের সাদা চুল ও দাড়ির বিষয় মাথায় রাখতেন। তাঁর পোশাক তাই তাকে বিনে কোন অর্থই বহন করে না।
আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে কবির ১৯৩০ সালে প্রথম দেখা হওয়ার জামাটা দেখতে পারেন। সেটিও তাঁর নিজের ডিজাইন করা। এটির রং সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তবে, আইনস্টাইনের ভাগনে এটিকে ‘ব্রাইট কালার’ বা উজ্জ্বল রঙের বলে উল্লেখ করেছেন। আগের জামা থেকে এর পার্থক্য হলো এটিতে ওপরের আলোয়ানটা নেই। মানে, এটি কেবলই একটি জোব্বা। তবে, এটি বোতাম আটকানো। বেতাম ভেতরের দিকে হওয়াতে ছবিতে দেখা যায় না। এর মানে হলো এটি গলা ঢুকিয়ে পাঞ্জাবি বা এখনকার জোব্বার মতো পরতে হতো না। শার্টের মতো করেই পরা যেত।
মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর বাসভবন, এখন যা রবীন্দ্র জাদুঘর নামে পরিচিত সেখানে কিংবা শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের ডিজাইন করা অনেক আসবাব দেখা যাবে। ১৯১৬ সালে জাপান সফরে গেলে জাপানের ‘মিনিমাল’ বাড়িঘরের প্রেমে পড়েন। তাঁর ইচ্ছা হয়, জাপানের সুন্দর বাড়ি তুলে নিয়ে যেতে। পরে শান্তিনিকেতনে তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেন। জাপানি আদলে শান্তিনিকেতনের বেশির ভাগ আসবাবই রবি ঠাকুরের ডিজাইন করা।
অসুন্দর জিনিসে অ্যালার্জি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি সুন্দরের পূজারি। তাঁর পোশাক কিংবা আসবাবে তিনি যেসব দেশ ঘুরেছেন, তার প্রভাব দেখা যায়। পোশাকে সিকিমের বাখু, ভুটানের ঘো, জাপানের কিমোনো কিংবা আমাদের অরিজিনাল জোব্বা—সবই তাঁকে প্রভাবিত করেছে। তবে, তিনি শুধু দেশীয় ম্যাটেরিয়ালই ব্যবহার করতেন। কাপড় সবই আমাদের তাঁতের। ডিজাইনে কসমোপলিটন একটা ছোঁয়া থাকলেও রবি কবি আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন।
আর জামা কাপড় যা ডিজাইন করতেন সবই নিজের জন্যই করতেন। মৃণালিনী দেবী, কাদম্বরী দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী কিংবা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাঁর ডিজাইন করা জামাকাপড় পরতেন কি না, সেটা অবশ্য আমি ঠিক জানি না।
রোমান হলিডের নায়িকা অড্রে হেপবার্নের স্মরণসভায় অভিনেতা গ্রেগরি পেক রবীন্দ্রনাথের ‘আনএন্ডিং লাভ’ বা ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
I seem to have loved you in numberless forms, numberless times…
In life after life, in age after age, forever.
My spellbound heart has made and remade the necklace of songs,
That you take as a gift, wear round your neck in your many forms,
In life after life, in age after age, forever.
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি/ শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়/ গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়/নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
আপনাকে আমরা ভালবাসি জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স ও সংগৃহীত