তত দিনে দ্বিধাবিভক্ত তাঁদের ছয় দশকের বেশি পুরোনো পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। মেয়েটি তখন সবে হার্ভার্ডে মাস্টার্স শেষ করেছেন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারে। এর আগে আর্কিটেকচার ও ভিজুয়াল আর্টসে গ্রাজুয়েশন করেছেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে। ঐ সময়েই স্বপ্নের মতো একটা চাকরির অফারও তাঁর ছিল নিউইয়র্কে। এদিকে বাবা চাইছিলেন মেয়ে দেশে ফিরে এসে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাক। মেয়ের ভেতর বলতে গেলে অভিন্ন ভাবনাই কাজ করছিল; অথচ সেটা তখনো বাবার অগোচরে ছিল।
মেয়েটি কখনোই চায়নি বিদেশে থেকে যেতে। বরং বাংলাদেশে ফিরে নিজেই একটা সফলতার গল্প লিখতে চেয়েছে। ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছে বিদেশে পড়তে গিয়ে আমাদের আত্মজদের ফিরে না আসার বদনাম। আর অবশ্যই হতে চেয়েছে অনুসরণীয়।
তবে হ্যাঁ ছোটবেলা থেকে তৈরি পোশাকশিল্পের চৌহদ্দিতে বেড়ে উঠলেও কখনোই সেখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাননি। বরং বাবাকে নানাভাবে সহায়তা করলেও নিজের নতুন জগৎ তৈরিই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
এদিকে মেয়ে ফিরবে এই আশ্বাসে ফুল্ল বাবা দেশে ফিরে মেয়ের জন্য একটা বড়সড় ডিজাইনের বই প্রস্তুত করে রাখলেন। সেখানে নানা ধরনের ডিজাইনের মধ্যে আসবাবের নকশাও ছিল।
যাহোক, তিনি দেশে ফিরলেন। পরিপার্শ্ব দেখলেন। তারপর মাঠে নেমে পড়লেন। ডিজাইনের পাশাপাশি রসনাপ্রিয়তাও তাঁর আরেক আবেগের নামান্তর। ফলে দেশে বা বিদেশে ভালো কোন কুজিন কিংবা রেস্তোরাঁর খোঁজ পেলে হাজির হয়ে যাওয়া তাঁর স্বভাব। তাই তাঁর প্রথম উদ্যোগটা ছিল খাদ্যসম্পর্কিত। তিনি শুরু করলেন খাঁটি জাপানি রসনালয়। ইজাকায়া। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে। আবাহনী মাঠের উল্টো দিকে। দেখেশুনে একজন ভালো শেফ আনলেন। ইজাকায়া অতএব করোনাপূর্ব সময়ে হয়ে উঠল ঢাকার রসনাবিলাসীদের জন্য হ্যাপেনিং প্লেস।
ইতিমধ্যে তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান নতুন নামও নিয়েছে। ডেকো ইশো গ্রুপ। নতুন শব্দটি সংযোজনে তাঁর ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। প্রায় সমসময়ে তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান একটি স্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড কিনে নতুন নামে (ক্লাবহাউজ), নতুন ব্র্যান্ডিংয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটিরও নেপথ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ভোগের ফটোগ্রাফার আনছেন। আনছেন সেখানকার শীর্ষ মডেলও। ফলে ফ্যাশন ফটোগ্রাফি পাচ্ছে নতুন মাত্রা। আর তাঁর উদ্যোগ প্রশংসিত ও অনুসৃত হচ্ছে। এরই মধ্যে ব্র্যান্ডটি ফ্যাশনপ্রিয়দের কাছে সবিশেষ সমাদৃত।
ক্লাব হাউজের একেবারে নির্মাণপর্বে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। ফলে ক্লাব হাউজ আর ইজাকায়ার উত্থানপর্ব দেখার সুযোগ হয়েছে কাছ থেকে। এমনকি তাঁর তৃতীয় তথা এখনকার মূল উদ্যোগকেও। অনিয়মিত হলেও একটা যোগাযোগ আমাদের ছিল। সম্প্রতি দেখা আর কথা হলো বেশ একটা লম্বা বিরতির পর।
সে প্রসঙ্গে আসার আগে বুড়ি ছুঁয়ে আসা যাক তাঁর তৃতীয় তথা মূল উদ্যোগের সূচনায়। ক্লাবহাউজ নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ডিজাইন নিয়ে কিছু একটা করার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন।
বিদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য তাঁরা বছরের পর বছর ধরে কাজ করছেন। এ জন্যই তাঁর অভিপ্রায় ছিল নিজেদের একটা ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে সেটা আবিশ্ব জনপ্রিয় করে তোলা। তবে সেটা যে পোশাকেরই হতে হবে, তা নয়।
আবার আসবাবের বিষয়টিও যে তাঁর ভাবনায় ছিল এমনও নয়; বরং তাঁর সমবয়সীদের যাঁরা দেশে আছেন কিংবা বিদেশ থেকে পড়ে এসে দেশে কিছু করছেন, তাঁদের চাহিদা দেখেই এই খাতে একটা বড় ধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। ভাবনার ক্যানভাসে পড়তে থাকে নানা রঙের পোঁচ। দেশের বৃহত্তর তরুণ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা, চাহিদা আর রুচি অনুঘটক হয় ছবিটা পূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করতে।
আস্তে আস্তে তিনি শুরু করেন প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্ক, সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে তবেই বাড়ান পা, নতুন পথে। সে পথ ফুল বিছানো হবে না, সেটা জানতেন। অসম ময়দানে লড়ার বিষয়টিও ছিল জানা। কিন্তু অকারণে, অন্যায়ভাবে পথরোধের চেষ্টা যে করা হতে পারে, সেটা তাঁর কল্পনায়ও আসেনি।
এসবই বলছিলেন রায়ানা হোসেন। ইশোর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী। বনানীতে একটা বিশাল ফ্লোরজুড়ে তাঁর এখনকার অফিস। একঝাঁক তরুণের উপস্থিতিতে মুখর আবহ। নকশা থেকে বাজারজাতকরণ আর বিপণন, দেশ–বিদেশে বাজার বিস্তার মায় সবকিছুতেই এদের সবর উপস্থিতি। আর এই কর্মযজ্ঞে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রায়ানা। সেদিন দেখা হলো তাঁর সদ্য শুরু দ্বৈতজীবনের সঙ্গীটির সঙ্গেও।
নানা প্রসঙ্গে আমাদের আবর্তিত কথোপকথনের শুরুতে হাসতে হাসতেই রায়ানা বলছিলেন তৈরি পোশাকের আবহে বেড়ে ওঠা আমার স্বাদকোরকও বেশ আবেগপ্রবণ। আর এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে আরও একটা ‘এফ’। আমার জীবন তিন এফ–ময়। ফ্যাশন, ফুড আর ফার্নিচার। অবশ্যই এখন আমার ভাবনার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে আসবাব। আর কিছুটা রসনা।
শুরু করেন মাওনাতে স্টেট অব দ্য আর্ট ফ্যাক্টরি দিয়ে। সূচনায় তিনি চেয়েছিলেন অনলাইনে আসবাব বিক্রি করতে। তাঁর এই পরিকল্পনা সত্যিই ক্রেতাদের কাছে আদৃত হয়েছে। কারণ, শুরুতে কোনো ফিজিক্যাল স্টোর না করে অনলাইনে নির্ভর করা ঝুঁকি ছিল বৈকি। বিশেষত আসবাবের ক্ষেত্রে। যদিও তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটা ফ্ল্যাগশিপ স্টোর করে ফেলেন বারিধারায়।
এরই মধ্যে আসে অতিমারি। সবকিছুর ফিজিক্যাল উপস্থিত যখন নসাৎ তখন সবাই ঝুঁকেছে অনলাইনে। তরুণেরা ছিল সবার থেকে এগিয়ে। ফলে ইশোর সমস্যা হয়নি। বরং পরে বাজারজাতকরণে এই ব্র্যান্ডের উদ্ভাবনী চমকে ক্রেতারা যারপরনাই আকৃষ্ট হয়েছে।
এরই মধ্যে ডিজাইনের অভিনবত্ব তো ছিলই। আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইন, কাঁচামাল ও অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে বিপণনের সহজতা ইশোকে দেশময় ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। একটা সময় মনে হয়েছিল ইশোর পণ্য বোধ হয় ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে ইশো–অনুরাগীরা। বরং এখন আমাদের আসবাব যাচ্ছে সারা দেশে। এই আসবাবের বদৌলতে সমান্তরালে বদলে যাচ্ছে তাদের অভ্যন্তর সজ্জা। সেটাই আমাকে আরও মুগ্ধ করছে। আমার কাছে এসবই যেন অবিশ্বাস্য; রূপকথার মতো।
একটু প্রসঙ্গ পাল্টে কথা পেড়েছি আর্কিটেক্ট রায়ানাকে নিয়ে। এই পেশায় কেন থাকতে ইচ্ছে হয়নি তাঁর?
—বলেছেন, আসলে একজন আর্কিটেক্ট হিসেবে আমার যে মাইন্ডসেট, যে ভাবনা আমার সেটা নিয়ে এখানে কাজ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। ক্লায়েন্টের ইচ্ছেমাফিক অনেক কিছুই করতে হয়। সেটা পারব না বলেই আমি ও পথে পা বাড়াইনি। আরও একটা বিষয়, একক স্থাপনা নয়, বরং আমার ফোকাস হলো শহর, তথা বৃহত্তর ইকোসিস্টেম। বিশেষ করে স্মার্ট শহর তৈরিই আমার লক্ষ্য। জীবনের কোনো এক বাঁকে সে স্বপ্ন নিশ্চয়ই সফল হবে।
ইশো প্রসঙ্গে ফিরে তাঁর সন্তুষ্টির কথা বলেন। কারণ, এই সাফল্য মাত্র চার বছরের। ইশো লঞ্চ করা হয় ২০১৯ সালে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আশা জাগায় আসবাব নকশা ও মান নিয়ে মানুষের শংসা।
তবে এখনো আসবাব নিয়ে সিংহভাগ মানুষের গড়পড়তা ধারণায় পরিবর্তন আসতে সময় লাগবে। অবশ্য সেটাকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখলেও অস্বস্তিতে আছেন আসবাবসংক্রান্ত সরকারি নিয়ম নিয়ে। কারণ, তৈরি আসবাব আমদানিতে যে শুল্ক, সমপরিমাণ প্রদেয় আসবাবের যন্ত্রাংশ আমদানিতেও। এই শিল্পকে তৈরি পোশাকশিল্প খাতের মতো এগিয়ে নিতে হলে অভিন্ন নিয়মই প্রত্যাশিত, অভিমত রায়ানার।
দেশে ফিরে আসবাবশিল্পে নিজেকে নিয়োজিত করার আগে ভাবেননি স্টেট অব দ্য আর্ট কারখানা শুরুতেই করবেন। একইভাবে স্মার্ট ফার্নিচার বানাবেন; সীমাবদ্ধ পরিসরে হলেও। এত দ্রুত এই আজকের অবস্থানে আসার বিষয়টি তাঁর কল্পনায় ছিল কি?
–আসলে এতটা শূন্যতা যে ছিল, এটাই আমি ভাবিনি। তবে হ্যাঁ আমরা একসঙ্গে সবকিছু করিনি। বরং আমাদের আজকের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ। পণ্য দিয়ে, বিপণন প্রচারণা দিয়ে আকৃষ্ট করেছি। অবশ্যই মানে আপস না করে। এই যেমন আমাদের পপআপ কনসেপ্ট। এটা তো একেবারেই অন্যতর ধারণা। ইশো পপআপ বিচ ক্লাব; এটা করেছি মাওয়ায়; সেখানে আমাদের পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। নানা ধরনের আসবাব। ইশোর ফার্নিচার ব্যবহারের অভিজ্ঞতা এখানে নিতে পারা যাবে। তা সে রেস্তোরাঁ হোক বা বিচ বা আউটডোর। মানুষ যাচ্ছে, সময় কাটাচ্ছে, উপভোগ করছে আর প্রশংসাও করছে। বস্তুত বাজারের চাহিদা অনুসারেই আমরা সঠিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছি।
এ মুহূর্তে ইশোর রেগুলার পণ্য ৯০ শতাংশ। আর স্মার্ট পণ্য ১০ শতাংশ। তবে আমার মনে হয়েছে, স্মার্ট ফার্নিচারের জন্য বাজার এখনো তৈরি না। আরও সময় লাগবে, অভিমত এই তরুণ উদ্যোক্তার।
ডিজাইন প্রতিযোগিতা করার একটা ভাবনাকে উড়িয়ে না দিলেও বললেন যে আর একজনের ডিজাইন নেওয়াটা দায়িত্বের। যথাযথভাবেই সেই ডিজাইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তবে সেটা নয় বরং আমরা বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এর জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আলাপ করেছি।
এ প্রসঙ্গের রেশ ধরে তিনি বললেন, আমাদের দেশে আর্ট আর আর্কিটেকচারে পড়ানোর পদ্ধতিটা আমার কাছে সঠিক নয়। কারণ, তাদের মাথা যখন স্থানীয় ভাবনায় ভারী হয়ে যায়, তখন তাদের গবেষণা করতে দেওয়া হয়। অথচ এটা হওয়া উচিত সূচনায়। তখন তাদের মাথাটা ফ্রেশ থাকে।
যাহোক, বাংলাদেশের আরও সমস্যা হচ্ছে অন্যকে ল্যাং মারা। কোভিডের পরপরই একটি স্থানীয় কোম্পানি আমাদের সঙ্গে সেটা করেছে। দ্বিগুণ বেতন দিয়ে আমাদের বারিধারার সব কর্মীকে নিতে চেয়ে পারেনি। আমাদের কর্মীদের এই অনড় অবস্থান এবং ইশোর পাশে থাকার মনোভাবকেই আমার মনে হয় এক বিরাট অর্জন। আর সেটা না পেরে অন্য পথ নিয়েছে ইশোকে অগ্রগিত থামানোর জন্য।
বাংলাদেশের আসবাবশিল্পে তিনটি মাইলফলক আছে। প্রথমটা অটবি, এরপর হাতিল আর বর্তমানে ইশো। যার যার সময়ে তারা ভোক্তাকে নতুন পণ্যে আকৃষ্ট করেছে। ভোক্তারুচির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাজারে একটা আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে।
এর মধ্যে মার্কেট শেয়ারের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইশো করোনাকালে নিজেদের ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মে দারুণ সফলতা পেয়েছে। এর কারণ আগে থেকে অবকাঠামো থাকা। আর ওই সময়ে কেউ অসুস্থ হয়নি। এর জন্য প্রয়োজনীয় সতর্ককতাও ছিল। প্রতিদিন দুবার করে প্রত্যেককে জীবাণুনাশী তরল স্প্রে করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে বললেন, এ মুহূর্তে ফ্যাক্টরি আর বাড়াচ্ছে না ইশো। বরং যেটা করা হয়েছে, তাতেই উৎপাদনের হার যথেষ্ট ভালো। এরই মধ্যে ফ্যাক্টরি অবশ্য আগের তুলনায় অনেকখানি গুছিয়ে ফেলার কারণে তা আরও কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে আসবাবের চাহিদা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে অন্য বাজার ধরাটা একান্ত আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য ভালো সম্ভাবনা হতে পারে। আমরা এসব বাজার এক্সপ্লোর করছি।
আবার তৈরি পোশাকশিল্পের উদাহরণ টেনে জানতে চেয়েছি পোশাকের মতো আসবাবেও কি অভিন্ন সম্ভাবনা আছে? কিংবা তিনি নিজে সেটা করতে চান কি না।
—প্রশ্নটা লুফে নিয়ে রায়ানা বললেন, কেবল নিশ্চিত না, আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত এটা হবে।
বাংলাদেশের ফার্নিচার মার্কেটে কোনো একটি ব্র্যান্ডকে ইশোর চেয়ে এগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে রায়ানার অভিমত, হাতিল। কারণ, তাদের মেশিনারি অনেক ভালো। তবে সেসব তারা কতটা ব্যবহার করে সুফল নিতে পারছে, সেটা অন্য বিষয়। এই প্রসঙ্গেে তিনি বললেন, বাংলাদেশের আসবাবশিল্পে তিনটি মাইলফলক আছে। প্রথমটা অটবি, এরপর হাতিল আর বর্তমানে ইশো। যার যার সময়ে তারা ভোক্তাকে নতুন পণ্যে আকৃষ্ট করেছে। ভোক্তারুচির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাজারে একটা আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে।
একজন মানুষের পক্ষে আসলে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। এটা আমি বুঝি। তবে আমি ভাগ্যবান আমার একটা বুঝদার টিম আছে। তারা আমাকে বোঝে। আমি যেটা করতে চাই তারাও সেটা করতে চায়। আর বিশ্বকে বোঝার জন্য আমি আমার ডিজাইন টিমকে একাধিকবার বিদেশে নিয়ে গিয়ে ট্রেনিং করিয়ে নিয়ে এসেছি।
ঠিক চার বছর পার করে মোটামুটি গুছিয়ে ওঠার পর আগামীর পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেছেন তিনি। দেশের বাইরে নিজেদের আউটলেট করা ছাড়াও ভাবছেন রপ্তানির কথা। এছাড়া পরিচালন ব্যবস্থায় কারখানা আর ব্র্যান্ড আলাদা করে ফেলছেন। উভয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। উভয়ই চলবে নিজের মতো করে সমান্তরালে।
তা ছাড়া কারখানাকে এমনভাবে স্ট্রিমলাইন করা হয়েছে, যাতে ইশোর জন্য নতুন নতুন ডিজাইনের আসবাব তৈরির পাশাপাশি অন্যদের আসবাবও তৈরি করে দিতে সক্ষম, বলে জানালেন রায়ানা। সঙ্গে আরও বললেন, আরও একটা বিষয় আমাকে উৎসাহিত করছে। সেটা বৈশ্বিক বাজার। এখানে সম্ভাবনা অপার।
এ প্রসঙ্গে ওয়ারেন বাফেট কোভিডকালীন আসবাব সংস্কার থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করেছেন উল্লেখ করে বিশ্ববাজারে আসবাবের সম্ভাবনার বিষয়টি ব্যাখ্যাও করলেন।
এই বাজার ধরার ক্ষেত্রে কেবল ভাবনা নয়, প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুরে নিবন্ধন করেছেন। ভারতেও নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় আছেন। আর বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশে নামের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়ে গেছে। অতএব এক বছরের মধ্যেই ইশোর আসবাব আন্তর্জাতিক বাজারে থাকবে বলেই আশাবাদী রায়ানা।
আবার তৈরি পোশাকশিল্পের উদাহরণ টেনে জানতে চেয়েছি পোশাকের মতো আসবাবেও কি অভিন্ন সম্ভাবনা আছে? কিংবা তিনি নিজে সেটা করতে চান কি না।
—প্রশ্নটা লুফে নিয়ে রায়ানা বললেন, কেবল নিশ্চিত না, আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত এটা হবে।
এই উত্তরের রেশ ধরে বললেন, ইশোর কারখানার পাশেই আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। সেখানে তো বায়াররা নিয়মিত আসে। কথাও হয়। প্রত্যেকেরই এখন হোম আছে মানে অন্দরের জন্য প্রয়োজনী পণ্যের লাইন আছে। জারার হোম আছে, এইচঅ্যান্ডএম কিংবা মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সারেরও হোম আছে। অতিসম্প্রতি নেক্সটও যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ফার্নিচার কোম্পানি মেডডটকমকে কিনল। সুতরাং সম্ভাবনা বিপুল। আর বাবার বায়াররা তো পাশেই ইশোর ফ্যাক্টরি দেখে, বাংলাদেশে এমন আসবাব তৈরি হতে দেখে অবাক হয়। আস্তে আস্তে তাদের আগ্রহ বাড়ছে, সেটা টের পাই।
অতএব সরকার সঠিক এবং সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করলে, আশা করি সেটা করবে, এই শিল্প খাতও তৈরি পোশাকশিল্প খাতের মতোই বড় হয়ে উঠবে। তবে হ্যাঁ, এটা ইশোর একার পক্ষে সম্ভব নয়; বরং হাত বাড়াতে হবে হাতিল, আখতার, নাদিয়া বা শীর্ষ সারির আরও যেসব ব্র্যান্ড আছে সবাইকেই। অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
সাধারণত আপনার মতো শিল্পপতিদের ছেলেমেয়েরা ফিরে এসে বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়ে একটা নিরাপদ জীবন বেছে নেয়। সেখানে আপনি এভাবে নিজেকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে প্রতিনিয়ত সফল হয়ে চলেছেন। এর পেছনের প্রেরণাটা কী? কেই–বা আপনার রোল মডেল?
—আসলে আমি এমনই। আর আমার বাবা কিংবা দাদা উভয়েই এভাবে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছেন। সেই সাতচল্লিশ সালে রক্সি পেইন্ট শুরু করেছিলেন আমার দাদা। কাগজে–কলমে যদিও বলা হয় ১৯৫৩। কারণ, ওই বছর নিবন্ধিত। তিনি পেরেছেন। আমার বাবাও তা–ই। তিনিও দাদার ব্যবসায় না গিয়ে নিজে শুরু করেন। বলতে পারেন আমি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি।
শেষে এসে কৌতূহল নিরসন করি। আমি জানতাম আপনি বিয়ে করছেন। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি আপনি আমাকে আসতে বলায়। কারণ, বিয়ের পর সবাই হানিমুনে যায়। আর আপনি অফিস করছেন। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।
হাসতে হাসতে রায়ানা বললেন, এটাই তো আমি। আর হানিমুনের সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। বরং এই সময়ে অফিস করাটাই জরুরি। রোজা শুরু হয়েছে। সামনে ঈদ। ব্যবসার মাস এটা। অতএব সময় দিতেই হবে। হানিমুনে পরে যাওয়া যাবে। ঈদের ছুটিতেই না হয় যাব।
এই অভিনিবেশ আর প্রত্যয়ের গল্প শুনতে শুনতেই উঠে আসি সেদিন; রায়ানা হোসেনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে। ধন্যবাদ তিনিও জানান আমাদের পাঠকদের।
ছবি: ইশো