কল্পকাহিনি মিশে গেছে চরম বাস্তবতায়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মেঘদলের পরিবেশনায় চমৎকার গানটির মতো করে বলা যায়, ‘এ হাওয়া আমাদেরকে নেবে বহুদূরে’। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’। মুক্তির আগে থেকেই এর ব্যতিক্রমী ভাইরাল হওয়া গান, ট্রেইলার ও পোস্টারে ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অত্যন্ত বাস্তবধর্মী লুকের কারণে আলোচনা ও আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে ‘হাওয়া’। এদিকে মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসায় ভাসছেন চলচ্চিত্রে ডেব্যুতেই ছক্কা হাঁকানো গুণী নির্মাতা ও পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। হালফ্যাশনের সঙ্গে এক অত্যন্ত আন্তরিক আলাপচারিতায় তিনি ‘হাওয়া’ নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা, ছবিটি নির্মাণের নানা দিকসহ চমকপ্রদ সব ঘটনার কথা সবিস্তার জানান।

মেজবাউর রহমান সুমন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফেসকার্ডের প্ল্যাটফর্ম থেকে বহু জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনচিত্র ও দারুণ কিছু টেলিভিশন নাটক নির্মাণ করেছেন এযাবৎ। তবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর মুনশিয়ানা যেন আরেক ধাপ এগিয়ে। কথোপকথনে প্রথমেই চলে আসে বিষয়বস্তু ও প্লটের কথা। বলেন, ছবির জন্য সমুদ্রের গভীরে জেলে নৌকায় শুটিং করা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে তাদেরই জীবন ও মানসিকতার গল্প।

বিজ্ঞাপন

আলাপচারিতার প্রথমেই এ নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহল জাগানো এক অজানা তথ্য দিলেন মেজবাউর সুমন। আমাদের অনেকেরই জানা নেই, কুসংস্কার বা যেকোনো কারণেই হোক, উপকূল অঞ্চলে সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকায় নারীর উপস্থিতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই আদিকালের মতো এখনো নারী ব্রাত্য, অশুচি, অপয়া তাদের কাছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে মেজবাউর সুমনকে প্রথমেই। তিনি জানান, ছবির মূল চরিত্রের একজন গুলতি এবং ইঞ্জিনরুমে যেসব নারী কাজের প্রয়োজনে যাতায়াত করবে, তাদের রীতিমতো সোনা-রুপা ধোয়া পানি ছিটিয়ে ‘শুদ্ধ’ করেই ট্রলারটিতে ওঠার অনুমতি দেয় এর মালিক। ছবিটির বিষয়বস্তুতে উঠে আসা গুলতির প্রতি নেতিবাচকতার ব্যাপারটি একেবারেই মিলে যায় এ ঘটনার সঙ্গে।

মেজবাউর সুমনের সাবলীল গল্পকথনে জানা গেল দীর্ঘ দুই বছর, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রীতিমতো সমুদ্রমন্থন করে ফেলেছেন তিনি জেলেপাড়া ও বেদেপল্লি থেকে এই ছবির সত্যিকারের চরিত্রগুলোকে তুলে আনতে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে কয়জন এভাবে কাজ করে, তা সত্যিই বলা কঠিন। সুমন বলেন, চান মাঝি, ইব্রাহিম, গুলতি, উরকেস, পারকেস, নাগু, মরা, ইজা, ফণী—প্রতিটি চরিত্রের জন্য মানানসই সত্যিকারের মানুষ বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রচুর ছবি, ভিডিও ও স্কেচের মাধ্যমে তাদের লুক, ভাবভঙ্গি, পোশাকপরিচ্ছদ, কথা বলার কায়দা—সবকিছু ঠিক করা হয়েছে। শুটিংয়ের শুরুতে তা দেখিয়ে কলাকুশলীদের বলা হয়েছে, ঠিক এ রকমই হবে চরিত্রটি।

বিজ্ঞাপন

সুমন জানান, গুলতির চরিত্রের জন্য যে সত্যিকারের বেদে মেয়েটিকে নির্বাচন করা হয়েছিল, নাজিফা তুষি তাদের সঙ্গে গিয়ে থাকতেন, সময় কাটাতেন বেদেপল্লিতে। মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি এই বেদেপল্লির সেই বেদে নারীও আসতেন ঢাকায়। দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর চলনবলন, ভাবভঙ্গি এবং শাড়ি পরার কায়দা শিখে নিয়ে তবেই তুষি নিজেকে তৈরি করেছেন গুলতি হয়ে ওঠার জন্য।

চঞ্চল চৌধুরীর করা চান মাঝি চরিত্রটির কথা বলতে গিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন মেজবাউর সুমন। বলেন, যে বাস্তব চরিত্রকে অবলম্বন করে এই জটিল চান মাঝিকে গড়ে তোলা হয়েছে, তার কণ্ঠের সঙ্গে মিল রেখে চঞ্চল চৌধুরীকে রীতিমতো চিৎকার করে গলা ভেঙে সেই ফ্যাসফেসে টোনে ডাবিং করিয়েছেন তিনি।

ছায়াছবির কস্টিউম ও লুক তৈরির ব্যাপারে সহকর্মী আনিকা জাহীনকেই কৃতিত্ব দিলেন মেজবাউর সুমন। জানান, ছবির অভিনেতাদের পোশাক সংগ্রহ করা হয়েছে কড়াইল বস্তি, কেরানীগঞ্জ ও কক্সবাজারের জেলেপাড়া থেকে। মেকআপের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় মেকআপ এক্সপার্ট সঞ্জয় পাল কাজ করলেও সুমন জানান, তিনি শুটিংয়ের ১৫ দিন আগে এসেছিলেন। তাই এর আগেই হাওয়া টিম বেশ কয়েকবার চরিত্রগুলোর লুক টেস্ট সম্পন্ন করে ফেলেছিল। মেজবাউর সুমন বারবার একটি জিনিসের ব্যাপারে জোর দিলেন। তা হলো সত্যিকারের চরিত্রগুলোর যথাসম্ভব অনুসরণ করাই এই ছবির চরিত্রায়ণের মূল লক্ষ্য ছিল। প্রতিটি চরিত্রই তাই এভাবে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে দর্শকের কাছে। সুমন জানালেন, এই শুটিংয়ের আগে ভিডিও করা জেলেপাড়ার মানুষের জীবনযাপন, সমুদ্রযাত্রা, মাছ ধরা, নৌকার জীবন, আচার আচরণ—সবকিছু মিলিয়ে একটি ডকুমেন্টারি করা হয়েছে, যা অচিরেই প্রকাশ করবেন তিনি।

শুটিংয়ের সময়ের কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর আর আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন মেজবাউর সুমন। শর্ষের তেল মেখে কড়া রোদে পড়ে থেকে সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে ত্বকে পোড়া ভাব এনেছেন। তুষিও বাদ যাননি। রাজের তো চামড়া ফেটে গিয়েছিল, জানালেন সুমন। ছবির প্রধান চরিত্রটির অভিনেতা পান খেয়ে দাঁতের পাটিতে দাগ ফেলে ক্রুর কুৎসিত হাসি রপ্ত করার মতো ব্যাপার কমই ঘটে এ দেশে। আর ‘হাওয়া’ টিমের কথাও বারবার বললেন সুমন। টিমের সদস্যরা বেশির ভাগই সুমনের দীর্ঘদিনের সহকর্মী। তাই বোঝাপড়াটাও খুব ভালো হয়েছে পুরো টিমের সঙ্গে, বললেন এই গুণী নির্মাতা।

কথা যেন আর ফুরাচ্ছিল না। তবু কিছুটা ইতি টানার দিকে এগিয়ে মেজবাউর সুমন বলেন, এ ছবির প্রধান ব্যাপারটি আসলে আধুনিক যুগের পটভূমিতে কল্পকাহিনির অবতারণা করা, সেই কল্পিত চরিত্রকে বাস্তব জগতের নিরিখে উপস্থাপন করা।

আমাদের সমাজের ভালো-মন্দ মানুষগুলোর সত্যিকারের উপাখ্যানে এই প্রতিশোধ, হিংসা, লালসা, ঘৃণা, বিবাদ—সবকিছুই মানুষের মানবিক দিকগুলো বদলে দিচ্ছে। এরই বিপরীতে প্রকৃতির মহাশক্তিকে দাঁড় করিয়ে তার বিশালতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চেয়েছেন তিনি, বলেন সুমন। ‘হাওয়া’ ছবিটির মধ্য দিয়ে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, মানুষ বদলে যায়, কিন্তু প্রকৃতি এক ধ্রুবকস্বরূপ—এ কথোপকথনের শেষে বললেন মেজবাউর রহমান সুমন।

ছবি: ফেসকার্ড

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২২, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন