স্বস্তিকার সঙ্গে ফ্যাশন স্টেটমেন্টে বাঙালিয়ানা,আর ভেতরে-বাইরে সুন্দর থাকার গল্প
শেয়ার করুন
ফলো করুন

স্বস্তিকা মুখার্জি। নামটির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে শাশ্বত বাঙালি নারীর সৌন্দর্য আর আকর্ষণের রসায়ন। আসলে তাঁর অন্য রকম সৌন্দর্য, সাবলীল অভিনয়, বোল্ড ব্যক্তিত্ব আর আগলভাঙা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট—সব বয়সীকেই সমানভাবে টানে। সম্প্রতি দুই বাংলার এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী এসেছেন ঢাকায়। উড়াল দিলেন নিজ দেশের পথে আজই। এর ফাঁকে আজ ২৬ জানুয়ারি সকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকায় হাল ফ্যাশনের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে নানা প্রশ্নের অবতারণায় তাঁর ছকভাঙা ফ্যাশন আর লাইফস্টাইলের গল্প বললেন তিনি।

সাজপোশাকে বাঙালিয়ানাকে এত আকর্ষণীয় রূপে আর কেউ তুলে ধরতে পারে না আপনার মতো। এটা কি সহজাত? আপনার কী ভাবনা কাজ করে এ নিয়ে?

মা গোপা মুখার্জিই স্বস্তিকার শাড়ি-প্রেমের প্রেরণা
মা গোপা মুখার্জিই স্বস্তিকার শাড়ি-প্রেমের প্রেরণা

আমার সাজগোজ, অ্যাস্থেটিক সেন্স মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। শাড়ি পরতে ছোট থেকেই ভালোবাসি।  সেটাও আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি । ছোট থেকেই দেখেছি, মা খুব কম সময়ে অবলীলায় শাড়ি পরে ফেলতেন। তাঁকে আমি কোনো দিন দেখিনি শাড়িতে সেফটি পিন ব্যবহার করতে। আমিও খুব ভারী সিল্ক না হলে সেফটি পিন ব্যবহার করি না। শাড়ি পরতে এখন আর উপলক্ষের দরকার পড়ে না। আমি অনেক ধরনের ড্রেপিং শিখেছি ভারতের নামী আর গুণী ড্রেপিং শিল্পীদের কাছ থেকে। তবে শাড়ি পরার সময় মনে হয়, যেভাবে আমরা সব সময় ড্রেপিং করে এসেছি, সেটাই সবচেয়ে সুন্দর আর কমফোর্টেবল। আমার মনে হয়, ফ্যাশন সেন্সটা আমাদের ভেতরেই থাকতে হবে। সেটা বাইরে থেকে ধার করলে, খুব কম সময়ের জন্য তা কাজ করে। তারপরও সব দিক থেকে আমার মনে হয় নারীকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায় শাড়িতে।

বিজ্ঞাপন

নারীর সহজাত সৌন্দর্য আর বডি পজিটিভিটি এখনকার ফ্যাশন–দুনিয়ায় কতটা স্বীকৃত? আপনার নিজের উপস্থাপনায় এ ব্যাপারটি কীভাবে রাখেন?

আমরা এখন অনেক বেশি আলোচনা করি বডি পজিটিভিটি নিয়ে। কয়েক বছর আগেও এটা নিয়ে কথা হতো না। আমরা ভাবি, মোটাদের নিয়েই অনেক সমালোচনা হয়। কিন্তু রোগাদেরও বডি শেমিংয়ের শিকার হতে হয়। আমি বলব, মহিলা বা মেয়েদের শরীর নিয়ে সচেতন থাকা দরকার, তবে সেটা সুস্থ আর ফিট থাকার জন্য। অন্যের কথায় কান দিয়ে নয়। সব সময় একই রকম ফিগার থাকতে হবে, তেমনটা নয়। তাই আমি সব সময় অন্যকে সাহস জোগানোর জন্য কথা বলি। আমি নিজেও প্রয়োজনে রোগা হয়েছি। আবার সার্জারি, অসুস্থতা কিংবা জিমে না যাওয়ার কারণে ওজন বেড়ে গেছে। শরীর অনুযায়ী যে জামা কাপড় পরলে ভালো লাগে বা মানায়, যেটা পরলে নিজের আনন্দ আর আরাম হয়, সেটাই পরা উচিত।

স্বস্তিকার বয়ানে,'দেখতে কেমন লাগছে, সেটা অন্যকে জিজ্ঞাসা না করে নিজেকে আগে অনুভব করতে হবে এবং সেটাকে বিশ্বাস করতে হবে'।
স্বস্তিকার বয়ানে,'দেখতে কেমন লাগছে, সেটা অন্যকে জিজ্ঞাসা না করে নিজেকে আগে অনুভব করতে হবে এবং সেটাকে বিশ্বাস করতে হবে'।

যেটা বলিউডের নায়িকারা পরছে, সেটা অন্ধের মতো অনুসরণ করতে হবে এমনটা নয়। আমরা প্রচুর ম্যাগাজিন বা ইনস্টাগ্রাম দেখি, যেখানে ফিল্মস্টারকে স্বপ্নের মতো লাগে। কিন্তু সেই লুকের পেছনে কিন্তু অনেকের হাত থাকে। তাঁর মেকআপ টিম আছে, তাঁর স্টাইলিস্ট আছে। আমরা স্বাভাবিকভাবে যেমন বা সাধারণভাবে বাড়িতে যেমন থাকি, সেই আমিটাকেও গ্রহণ করাটা খুব দরকার। মেকআপ করা খারাপ নয়, কিন্তু মেকআপ ছাড়া চেহারা বা আমরা সাধারণ যেমন জীবন যাপন করি, সেটা দেখতে যেমন ভালো লাগে, সেই ব্যক্তিত্বের ওপরও যেন মানুষের আস্থা থাকে। এই ব্যাপারগুলো আমি গোটা ক্যারিয়ারেই চেষ্টা করেছি মানতে। প্রায় ২৩ বছর হলো আমি কাজ করছি। মানুষের ভালোবাসাটা যদি একই রকম থাকে, তাহলে তাঁর পেছনে ব্যক্তিত্বটাও একটা কারণ। নিজের প্রতি আস্থা থাকাটা আসলে খুবই দরকার। নিজের ভালো থাকা অন্যের ওপর নির্ভরতা থেকে আসা উচিত না। আমাকে দেখতে কেমন লাগছে, সেটা অন্যকে জিজ্ঞাসা না করে নিজেকে আগে অনুভব করতে হবে এবং সেটাকে বিশ্বাস করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আপনার প্রিয় শাড়ি কোনটি? বাংলাদেশের কোন শাড়ি প্রিয় আপনার?

আমি হ্যান্ডলুম শাড়ি বেশি পরি। সিল্কের শাড়িও পরি। কারণ, আমার মায়ের অনেক অনেক সিল্কের শাড়ি রয়ে গেছে। না পরলে হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি হ্যান্ডলুম সুতির শাড়ি পরতে ভীষণ আরাম বোধ করি, ভালোবাসি। আর বাংলাদেশের পছন্দের শাড়ি অবশ্যই জামদানি। আমার সাদা জমিনের প্রচুর জামদানি শাড়ি আছে। তবে এবার ঢাকায় এসে খুব সুন্দর লাল, সোনালি রঙের জামদানি উপহার পেয়েছি। আমরা ভাবি যে লাল রং কেবল উৎসব-অনুষ্ঠানে পরার জন্য।

হ্যান্ডলুম সুতির শাড়ি পরতে ভীষণ আরাম বোধ করেন, ভালোবাসেন স্বস্তিকা
হ্যান্ডলুম সুতির শাড়ি পরতে ভীষণ আরাম বোধ করেন, ভালোবাসেন স্বস্তিকা
গয়না পরতেও খুব ভালো লাগে তাঁর। বিশেষ করে নাকছাবি।
গয়না পরতেও খুব ভালো লাগে তাঁর। বিশেষ করে নাকছাবি।

কিন্তু এখন ফ্যাশন ট্রেন্ডে সব রংই পরা হয়। শাড়ি পরার জন্য নিজের কনফিডেন্স থাকাটা আসলে খুব দরকার। শাড়ির প্রতি ভালোবাসা থাকলে সেটা লাইফস্টাইলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর বাংলাদেশের ভারমিলিয়ন ব্র্যান্ডের সিল্ক খুব পছন্দের আমার। শাড়ি ছাড়াও গয়না পরতেও খুব ভালো লাগে আমার। বিশেষ করে নাকছাবি।

নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে আপনি কী করেন? কোনো টিপস দেবেন কি আপনার নারী ভক্তদের?

সত্যি কথা বলতে আমি নিয়ম মেনে কিছুই করি না। তবে আমার কাজের জন্য যেহেতু মেকআপ করতে হয়, তাই  দিন শেষে ঘরে ফিরে মেকআপ তোলাটা বা ক্লিন করাকে বেশি গুরুত্ব দিই । যদিও এখন কাজের ধরন অনেক পাল্টেছে, লাউড মেকআপ করা হয় না। অনেক সময় আমি যে ধরনের চরিত্রে কাজ করি, সে ধরনের চরিত্রের জন্য মেকআপ একদম করিও না বলতে গেলে। কিন্তু কোনো ইভেন্টে গেলে একটু-আধটু মেকআপ তো করতে হয়। তাই আমি খুব মন দিয়ে মেকআপ তোলার পদ্ধতিতে সময় দিই, যেন ত্বক থেকে সবটা ভালোভাবে উঠে যায়।

মেক আপ করলেও তা তোলার বিষয়ে খুবই যত্নশীল স্বস্তিকা
মেক আপ করলেও তা তোলার বিষয়ে খুবই যত্নশীল স্বস্তিকা

তবে আমি প্রতিদিন স্নান করে একটা ময়েশ্চারাইজার আর সানস্ক্রিন ব্যবহার করি। ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ড ফরেস্ট এসেনশিয়ালসের প্রোডাক্ট আমার পছন্দের। ওদের হ্যান্ড ক্রিমটাও ব্যবহার করি আমি। শুটিংয়ে মেকআপ নেওয়ার আগে ব্যবহার করি ইমোলিন প্রি–মেকআপ বেজ ক্রিম। আর মাসে একটা ফেশিয়াল করি পাড়ার পার্লার থেকে। চুলের যত্নের বেলায় এখন অনেক কিছু বেরিয়েছে। আমি সব সময় শালিমার নারকেল তেল দিই। তবে নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে সঠিক আর স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইলের দিকেই নজর দেওয়াটা জরুরি। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। পেট ঠিক থাকলে ত্বকও সুন্দর দেখায়। বেসিক যত্নটা নিলেই হবে। আর আমি অনেক জল পান করি, অনেক শাকসবজি আর ফল খাই। জিমে যাই। আর কিকবক্সিং আমি ভালো পারি। জিমে যাই ফিট থাকার জন্য।

স্বস্তিকার মতো আত্মবিশ্বাসী আর আগলভাঙা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করতে গেলে কী করা বা ভাবা উচিত এখনকার নারীদের?

নিজের প্রতি ভরসা রাখতে হবে। আমাকে যেটা মানায়, আমার শরীরে যেটা মানায়, সে ধরনের জামাকাপড় বাছাই করতে হবে। আমি যেন পোশাক পরি, পোশাক যেন আমাকে না পরে। আমি যেহেতু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি, তাই সব সময় শরীর আর চেহারা নিয়ে বেশি কথা হয়। পোশাক পরা নিয়ে অন্যের কটু কথা না মানাই ভালো। আমি খুবই সাস্টেইনেবল ফ্যাশনে বিশ্বাসী।

 আত্মবিশ্বাসী আর আগলভাঙা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করতে গেলে সবার আগ ভেতরটা সুন্দর হওয়া খুব দরকার
আত্মবিশ্বাসী আর আগলভাঙা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করতে গেলে সবার আগ ভেতরটা সুন্দর হওয়া খুব দরকার

দেখতে সুন্দর লাগার জন্য ঘন ঘন দামি ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে হবে, এটা আমি মানি না। আমি ৫০০ টাকার শাড়িও কলকাতা থেকে কিনে পরি। আমাদের মায়েদের ছোটবেলা থেকেই দেখেছি সব সময় একই পোশাক অনেকবার পরতে। সেটাই আসলে করা উচিত। আগামী প্রজন্মকে আমাদের শেখাতে হবে। আর আত্মবিশ্বাসী আর আগলভাঙা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করতে গেলে সবার আগ ভেতরটা সুন্দর হওয়া খুব দরকার। আমার বাবা সব সময় একটা কথা বলতেন। সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং। আমি সেই মননেই বড় হয়েছি। সবকিছু মিলিয়েই মানুষ সুন্দর হয়।

নারীদের প্রতি অন্যায়-অবহেলার প্রতিবাদে আপনি সোচ্চার । সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সাক্ষাতকার- অনেক জায়গাতেই আপনার সাহসী বক্তব্য পাই আমরা। এ ব্যপারে বলুন আমাদেরকে...

এত কিছু নিয়ে আমি প্রতিবাদ করেছি, লড়াই করেছি, যেগুলো মেয়ে হিসেবে হয়তো অনেকেই বলতে সাহস পায় না। সব সময় ভাবতাম, কী জানি মানুষের কাছে এটা ঠিকভাবে পৌঁছাবে কি না বা মানুষ কতটা বুঝবে কথার অর্থ। মানুষ আমার অভিনয় ভালোবাসে, কিন্তু আমি এত দিন ধরে যে জিনিসগুলো নিয়ে লড়াই করেছি, সেগুলোর জন্য মানুষ আমাকে বেশি ভালোবাসে। আমি কথা বলছি। আমাকে দেখে হয়তো আরও দশটা মেয়ে সাহস পাবে। আমার তো সব সময় এটাই মনে হয় যে সম্পর্ক ভাঙা, একা হয়ে যাওয়া কিংবা যেকোনো মানসিক সমস্যা নিয়েই হোক, আমরা যারা পাবলিক ফিগার রয়েছি, যারা আলোর নিচে থাকি, তারা যদি কথা বলতে এগিয়ে না আসি, তাহলে সাধারণ মেয়েরা কোথা থেকে সাহস পাবে!

'আমি এত দিন ধরে যে জিনিসগুলো নিয়ে লড়াই করেছি, সেগুলোর জন্য মানুষ আমাকে বেশি ভালোবাসে'
'আমি এত দিন ধরে যে জিনিসগুলো নিয়ে লড়াই করেছি, সেগুলোর জন্য মানুষ আমাকে বেশি ভালোবাসে'

যেমন আমি মাঝে খুবই সতর্ক থাকতাম যে আমার হাতটা মোটা, তাই হাতাকাটা ব্লাউজ আমি পরব না। তারপর একদিন ভাবলাম যে আমার মা, মাসি তাদের তো আমি সব সময় দেখেছি হাতাকাটা জামা পরতে। মায়ের হাত অনেক মোটা ছিল। সেটা তিনি কোনো দিন গ্রাহ্যই করেননি আর আমাদেরও চোখে পড়েনি। আসলে লোকের চোখে পরার আগে আমরা আমাদের নিজেকে নিয়ে বোধ হয় বেশি ক্রিটিসাইজ করি। হাত মোটা- চিকন যা-ই লাগুক আসলে, আমার পরতে ইচ্ছে হলে আমি পরব। জীবন একটাই।

হোটেল কক্ষে সাক্ষাতকারে অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি
হোটেল কক্ষে সাক্ষাতকারে অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি

ঢাকায় এসে এবারের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

২০০৮ সালে শেষবার  ঢাকায় এসেছিলাম। এবারের ঢাকা ট্রিপটা আসলে আমার জন্য বেশ স্পেশাল আর ইমোশনাল। কারণ, আমি কল্পনাই করিনি, এত ভালোবাসা পাব মানুষের। এ রকম উন্মাদনা হবে আমাকে নিয়ে আর আমার ছবি দেখার জন্য। আমার দেশে হয় সেটা জানি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি অনেকেই আমাকে নিয়ে পোস্ট করে। কিন্তু বাস্তবে যে এই দেশের মানুষের এত ভালোবাসা পাব ভাবিনি। একজন শিল্পী হিসেবে মনে হয় সবচেয়ে বড় পাওয়া এটা। এপ্রিলে আবার আসব। তখন যাদের সঙ্গে দেখা হয়নি দেখা করব।

ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও লেখক

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪: ৫৯
বিজ্ঞাপন