মাইকেল জ্যাকসনের কালোত্তীর্ণ ফ্যাশন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মাথায় আইকনিক টুপি, ছিপছিপে শরীরের সঙ্গে মিশে যাওয়া বডি হাগিং লেদার ট্রাউজার্স, বুক খোলা শার্ট, আইকনিক জ্যাকেট, সাদা দৃশ্যমান মোজা, গ্লাভস আর ট্রেডমার্ক জুতা—মাইকেল জ্যাকসনের সাজপোশাক তাঁর নাচ-গানের মতোই অনন্য। পপ কালচার বলি, আর ফ্যাশন—মাইকেল জ্যাকসন আসলে একটাই হয়। এমনকি এত বছর পেরিয়ে এখনকার জেনজি কালচারেও নতুন আঙ্গিকে আলোচিত হচ্ছেন এই সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্কিন সংগীতশিল্পী।

মাইকেল জ্যাকসনের সাজপোশাক তাঁর নাচ-গানের মতোই অনন্য
মাইকেল জ্যাকসনের সাজপোশাক তাঁর নাচ-গানের মতোই অনন্য

মাইকেলের উত্থান শুরু হয় ১৯৬৪ সালে একজন শিশুশিল্পী হিসেবে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘জ্যাকসন ফাইভ’ ব্যান্ড নিয়ে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। পরবর্তী সময়ে এই ব্যান্ডের গানগুলো সারা বিশ্বে অনেক সাড়া ফেলে।

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বহুল বিক্রীত গানের অ্যালবামের তালিকায় মাইকেল জ্যাকসনের অ্যালবামগুলো আছে। ‘অফ দ্য ওয়াল (১৯৭৯)’ , ‘থ্রিলার (১৯৮২)’, ‘ব্যাড (১৯৮৭)’, ‘ডেঞ্জারাস (১৯৯১)’, ‘হিস্টরি (১৯৯৫)’ ইত্যাদি অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবামের রেকর্ডের মধ্যে রয়েছে। ৪০ দশক, ৫০ দশক আর ৬০ দশকের বিখ্যাত শিল্পী বিল বেইলি, জন সাবলেট, ডায়ানা রস, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, জেমস ব্রাউন, মার্সেল মার্সো—এঁরা সবাই ছিলেন তাঁর সংগীত আর নৃত্যশৈলীর প্রেরণা। আজ ২৯ আগস্ট এই মহান পপ তারকার জন্মবার্ষিকীতে তাঁর চমকপ্রদ ফ্যাশন আর স্টাইল নিয়ে কিছুটা জেনে আসি চলুন।

বিজ্ঞাপন

মাইকেল জ্যাকসন বরাবরই পরিচিত ছিলেন তাঁর ব্যতিক্রমী, বহুল আলোচিত সাজপোশাকের জন্য। আশির দশকের ফ্যাশন আইকন হিসেবে মাইকেল জ্যাকসন সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তাঁর উজ্জ্বল, জাঁকজমকপূর্ণ, গ্লিটারে ভরা ও বর্ণিল আউটফিটের জন্য। ওই সময়ে তিনি ফ্যাশনে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত করেন।  লিঙ্গনিরপেক্ষ বা ইউনিসেক্স পোশাক পরতে ভালোবাসতেন তিনি ।

তবে তিনি সবচেয়ে আলোচিত তাঁর  ‘মিলিটারি জ্যাকেট’,  ক্ল্যাসিক ভেলভেটের তৈরি ‘ফিডোরা টুপি’, ‘অ্যান্টিগ্রাভিটি স্যু’ আর ‘অ্যাভিয়েটর সানগ্লাস’–এর জন্য। পোশাকে ঝিকমিকে রাইনস্টোনের ব্যবহার জ্যাকশনের আউটফিটের একটা লক্ষণীয় দিক ছিল। সত্তরের একঘেয়ে পপ ফ্যাশনকে ভাসিয়ে দিয়ে মাইকেল একাই ফ্যাশনে বিপ্লব নিয়ে আসেন। তিনি বেশি পরেছেন স্লিম ফিটিং শর্ট প্যান্ট, কখনো সাদা বা গ্লিটার দেওয়া মোজা আর পোশাকের অনেক জায়গায় থাকত চোখধাঁধানো ঝলমলে সিকুইন।

১. মটো জ্যাকেট (Moto জ্যাকেট)

মাইকেল জ্যাকসনের লেদারের কালো এই জ্যাকেটটিতে রয়েছে অসংখ্য জিপার ও স্ট্র্যাপ বাকল।
মাইকেল জ্যাকসনের লেদারের কালো এই জ্যাকেটটিতে রয়েছে অসংখ্য জিপার ও স্ট্র্যাপ বাকল।

লেদারের কালো এই জ্যাকেুটটিতে রয়েছে অসংখ্য জিপার ও স্ট্র্যাপ বাকল। এর সঙ্গে বটমে কালো স্কিনটাইট জিনস আর চোখে আইলাইনার তাঁর একটা আইকনিক লুক। জ্যাকসনের  বিখ্যাত ‘ব্যাড (১৯৮৭)’ অ্যালবামের কভারের ছবিতে এভাবেই দেখা যায় তাঁকে। অ্যালবামটি মুক্তি পাওয়ার পরেই এই আউটফিটটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় অনুরাগীদের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

২ .  মিলিটারি জ্যাকেট

সামরিক বাহিনী ও তাদের পোশাকের প্রতি আগ্রহ আর ভালোবাসা থেকেই মিলিটারি জ্যাকেট পরতেন তিনি
সামরিক বাহিনী ও তাদের পোশাকের প্রতি আগ্রহ আর ভালোবাসা থেকেই মিলিটারি জ্যাকেট পরতেন তিনি

মাইকেল জ্যাকসনকে প্রায়ই স্টেজ পারফরম্যান্স আর ওয়ার্ল্ড ট্যুরে মিলিটারি স্টাইলের জ্যাকেট পরতে দেখা যেত। সামরিক বাহিনী ও তাদের পোশাকের প্রতি আগ্রহ আর ভালোবাসা থেকেই তা পরতেন তিনি।  চাংকি বেল্ট, আর্মব্যান্ড, সিকুইন টাই, স্ট্র্যাপ দিয়ে তৈরি বিশেষ ডিজাইনের মিলিটারি জ্যাকেটের সঙ্গে সব সময় সানগ্লাস পরতেন তিনি।  

৩ . বিখ্যাত লাল লেদার জ্যাকেট

মাইকেল জ্যাকসনের এই জ্যাকেটটা ‘থ্রিলার জ্যাকেট’ নামেও পরিচিত
মাইকেল জ্যাকসনের এই জ্যাকেটটা ‘থ্রিলার জ্যাকেট’ নামেও পরিচিত

এই জ্যাকেটটা ‘থ্রিলার জ্যাকেট’ নামেও পরিচিত। ক্যান্ডি-অ্যাপল শেডের লালের সঙ্গে  কালো স্ট্রাইপ জুক্ত এই জ্যাকেটটি মাইকেল প্রথম পরেন ১৯৮৩ সালে, ‘থ্রিলার’ গানটিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন রোলিং স্টোনের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, এই জ্যাকেটটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে পরবর্তী সময়ে ১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিলামে বিক্রি হয় তা। তা ছাড়া ‘বিট ইট’ গানটিতেও তাঁর প্রিয় লাল রঙের লেদার জ্যাকেটটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

৪. ধবধবে সাদা গ্লাভস

এই গ্লাভসটি তাঁর বিখ্যাত  ‘বিলি জিন’ গানে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল ফ্যাশন জগতে
এই গ্লাভসটি তাঁর বিখ্যাত ‘বিলি জিন’ গানে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল ফ্যাশন জগতে
সিনথেটিক ফেব্রিক আর সোয়ারভস্কি পাথর বসানো গ্লাভসও তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন
সিনথেটিক ফেব্রিক আর সোয়ারভস্কি পাথর বসানো গ্লাভসও তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন

মাইকেল জ্যাকসন প্রথম এই সাদা সিকুইন দেওয়া গ্লাভসটি পরেছিলেন ১৯৮৩ সালে, একটি টিভি শোতে। বিখ্যাত ‘বিলি জিন’ গানটি প্রথমবারের মতো উপস্থাপন করেন সেখানে তিনি। এ সময় তিনি কালো লেদার প্যান্টের সঙ্গে কালো সিকুইনসজ্জিত জ্যাকেট পরেছিলেন। এর সঙ্গে  ডান হাতে পরেছিলেন সাদা সিকুইনের গ্লাভস। এই গ্লাভসটি তখন যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল ফ্যাশন জগতে। সিনথেটিক ফেব্রিক আর সোয়ারভস্কি পাথর বসানো গ্লাভসও তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন।

৫   সাদা-কালো স্যুট

‘ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট’ গানে এই ড্রেসটি পরে মূলত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান পপসম্রাট
‘ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট’ গানে এই ড্রেসটি পরে মূলত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান পপসম্রাট

মাইকেল জ্যাকসনের আরেকটি বিখ্যাত আউটফিট ছিল সাদা-কালো রঙের স্যুট। কখনো সাদা শার্ট, টি–শার্টের সঙ্গে কালো স্লিম শর্ট প্যান্ট। আবার কখনো কালো শার্টের সঙ্গে সাদা টি–শার্ট আর পায়ে কালো লোফারের সঙ্গে সাদা মোজা। ‘ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট’ গানে এই ড্রেসটি পরে মূলত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান পপসম্রাট।

৬ .  আর্মব্যান্ড

’আর্মব্যান্ড’ মূলত সারা বিশ্বের শিশুদের কষ্টের প্রতীক হিসেবে পরতেন তিনি
’আর্মব্যান্ড’ মূলত সারা বিশ্বের শিশুদের কষ্টের প্রতীক হিসেবে পরতেন তিনি
ডান বাহুতে স্যুট বা শার্টের সঙ্গে সাদা, কালো বা লাল রঙের আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যেত তাঁকে
ডান বাহুতে স্যুট বা শার্টের সঙ্গে সাদা, কালো বা লাল রঙের আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যেত তাঁকে

মাইকেল জ্যাকসনকে ডান বাহুতে স্যুট বা শার্টের সঙ্গে সাদা, কালো বা লাল রঙের আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যেত। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই স্টাইল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাইকেলের মতে, তার এই আর্মব্যান্ডটি মূলত সারা বিশ্বের শিশুদের কষ্টের প্রতীক। সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী আর অনাহারে থাকা শিশুদের উদ্দেশ্যেই এই আর্মব্যান্ড পরতেন তিনি।

৭.  ফিডোরা হ্যাট

মাইকেল জ্যাকসনের ’ফিডোরা হ্যাট’ পরবর্তী সময়ে আইকনিক স্টাইলে পরিণত হয়েছিল
মাইকেল জ্যাকসনের ’ফিডোরা হ্যাট’ পরবর্তী সময়ে আইকনিক স্টাইলে পরিণত হয়েছিল

মাইকেল জ্যাকসনকে ফিডোরা হ্যাটে শুধু স্টেজেই নয়, স্টেজের বাইরে যেমন যেকোনো পার্টি কিংবা শপিং মলেও দেখা যেত। সাধারণত তিনি সাদা ও কালো রঙের ফিডোরা হ্যাট ব্যবহার করতেন। পরবর্তী সময়ে এটা তাঁর আইকনিক স্টাইলে পরিণত হয়েছিল। যদিও ফিডোরা হ্যাট স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে অনেকেই ব্যবহার করে আসছেন। স্টাইলের দিক থেকে মাইকেল জ্যাকসন হ্যাটটিকে অনন্য অবস্থানে নিয়ে আসেন।

মাইকেল জ্যাকসনের ফ্যাশনের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তখনকার হলিউড, বলিউড তারকারাও বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্টাইল ধারণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তখন নয়, এখনো তাঁর আউটফিট আর স্টাইল অনেককেই প্রভাবিত করে। বর্তমান সময়ের অনেক সফল তারকা মাইকেলের স্টাইল থেকে অনুপ্রাণিত হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাডোনা, বিয়ন্সে, কানিয়ে ওয়েস্ট, লেডি গাগা, জাস্টিন টিম্বারলেক, জাস্টিন বিবার, ফেরেল উইলিয়াম, রিয়ানা, জায়ান মালিক,ঋত্বিক রোশন, শহীদ কাপুর, বরুণ ধাওয়ানসহ অনেকেই আছেন।

মাইকেল জ্যাকসনের আউটফিট আর স্টাইল  প্রভাবিত করে লেডি গাগাকে
মাইকেল জ্যাকসনের আউটফিট আর স্টাইল প্রভাবিত করে লেডি গাগাকে
মাইকেলের স্টাইল থেকে অনুপ্রেরণা পান জায়ান মালিক
মাইকেলের স্টাইল থেকে অনুপ্রেরণা পান জায়ান মালিক

বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ড যেমন, ভোগ, দিওর, গিভেঞ্চি, লুই ভিতোঁ মাইকেল জ্যাকসনের স্টাইলকে এক নতুন ধারায় নিয়ে গেছে। তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ফ্যাশন উইক ও শোতে। মাইকেলের ব্যক্তিগত ফ্যাশন ডিজাইনার ছিলেন মাইকেল বুশ আর ডেনিস থম্বকিং। তাঁর ওয়ার্ল্ড ট্যুরের প্রায় সব পোশাকেই রয়েছে বুশ আর থম্বকিংয়ের নিজস্ব নকশা। তাঁদের ভাষ্যমতে, মাইকেল ছিলেন একজন যুগোপযোগী অথচ সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া ফ্যাশন আইকন। ফ্যাশন তাঁকে অনুসরণ করত, তিনি ফ্যাশনকে না। স্টেজে প্রতিটি গানের শেষেই তাঁর পোশাক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন দক্ষ কর্মীরা।

মাইকেল ছিলেন একজন যুগোপযোগী অথচ সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া ফ্যাশন আইকন
মাইকেল ছিলেন একজন যুগোপযোগী অথচ সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া ফ্যাশন আইকন

বিশ্বখ্যাত এই শিল্পী ২০০৯ সালের ২৫ জুন, ক্যালিফোর্নিয়া শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি সবার মনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও তিনি বেঁচে রয়েছেন। বিশ্বের যেকোনো দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সবাইকেও জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে মাইকেল জ্যাকসনকে সবাই চেনেন আর ভালোবাসেন। আর তা শুধু তাঁর গান বা নাচের জন্য নয়, তাঁর অনুসরণীয় আর কালজয়ী ফ্যাশনের জন্যও।

ছবি: ইনস্টাগ্রাম ও পিনটারেস্ট

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৩: ০০
বিজ্ঞাপন