বর্তমান প্রেক্ষাপটে সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহৃত উপকরণগুলোর পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাব যথাসম্ভব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে গবেষক ও রূপবিশেষজ্ঞরা নিরলস পরিশ্রম করে আসছেন। কৃত্রিম রং ও সুগন্ধি এড়িয়ে চলা, অতিরিক্ত পানির ব্যবহার কমানো, প্যাকেজিংয়ের ব্যাপারে সচেতন হওয়া, প্রাণী বা জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করা—এসব মূলনীতির ব্যাপারে ক্রমেই আপসহীন হয়ে উঠছে বৈশ্বিক বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। আর এই দিনবদলের ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে সৌন্দর্যচর্চায় প্রয়োজনীয় প্রসাধনী উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এরই আরও কিছু উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক।
হেয়ার ও বডি কেয়ার প্রোডাক্ট, যেমন শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, শাওয়ার জেল, লোশন বেশির ভাগ সময় তরল বা ইমালশন অবস্থায় থাকে। এ জন্য এমন প্যাকেজিং প্রয়োজন, যাতে চুঁইয়ে না পড়ে এগুলো। ফলে বেশির ভাগ হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীল। একটি সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে একটি পরিবার গড়ে ২১৬টি প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করে। স্পষ্টতই এই বোতলগুলো পরিবেশের সবচেয়ে বড় দূষণকারী উপাদানগুলোর একটি। তবে এখন হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার সলিড অবস্থায় বাজারে এসেছে।
এই ‘বার’ শ্যাম্পুগুলোর প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে জীবাণু-বিয়োজ্য কাগজ বা অ্যালুমিনিয়ামের কৌটা। কিছু ব্র্যান্ড আবার কোনো প্যাকেটের ধার ধারছে না। যেমন বিউটি ব্র্যান্ড লাশ। খুব বেশি দিন হয়নি গার্নিয়ার, ল’রিয়েলের মতো জনপ্রিয় ও সহজলভ্য ব্র্যান্ডগুলো এ ধরনের প্রোডাক্ট উৎপাদন শুরু করেছে। মানুষও আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। তাই সলিড বিউটি প্রোডাক্টের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ছাড়াও ফেস ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন ইত্যাদি বার আকারে পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা অনেকেই জানি না যে বিশ্বে কৃষির পরেই সৌন্দর্যশিল্পে সবচেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক ইনফোর মতে, বেশির ভাগ সৌন্দর্যপণ্যের প্রধান উপাদান পানি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ ভাগ পানি ব্যবহার করা হয়। পানির এই অপচয় কমাতে হাজির হয়েছে ওয়াটারলেস বিউটি। অনেক বিউটি ব্র্যান্ডগুলো এখন পানিবিহীন পণ্য তৈরি করছে। এ ধরনের পণ্যে পানির বদলে অপর একটি দ্রাব্য অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রোডাক্টটি সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক বা কৃত্রিম প্রিজারভেটিভের বদলে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। বলে রাখা ভালো, বেশির ভাগ সিনথেটিক প্রিজারভেটিভ মানবদেহ ও পরিবেশ—কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ওয়াটারলেস বিউটির জন্ম হলেও এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পানিমুক্ত সৌন্দর্যপণ্য তৈরি হচ্ছে।
সাশ্রয়ী দেখে বহু বছর ধরে কসমেটিক ব্র্যান্ডগুলো সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এখন সেই চিত্রে পরিবর্তন আসছে। বেশ কিছু ব্র্যান্ড এখন পরিবেশবান্ধব উপাদান, যেমন বাঁশ, কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরি করছে। ইকোটুল এমন একটি বিউটি ব্র্যান্ড, যারা জীবাণু-বিয়োজ্য মেকআপ ব্রাশ, মেকআপ ব্লেন্ডার ও স্কিনকেয়ার টুল তৈরি করে এই ধারায় অগ্রগামী হয়েছে। এ ছাড়া দ্য বডি শপ, ওয়েস্টমেন অ্যাটেলিয়র, এলেইট কসমেটিকস, ভ্যাপার এ ধরনের সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরি করছে। শুধু মেকআপ টুলস নয়, টুথব্রাশ, চিরুনি, ডেন্টাল ফ্লস, কটন বাড এমন দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীরও টেকসই সংস্করণ পাওয়া যাচ্ছে এখন।
সৌন্দর্য উপাদানের টেকসই উৎসবিউটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য সৌন্দর্য পণ্যে ব্যবহৃত উপাদানের সাসটেইনেবিলিটি একটি বড় চিন্তার বিষয়। প্রসাধনী তৈরির উদ্দেশ্যে কিছু চাষ করার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অনস্বীকার্যভাবে পরিবেশে থেকে যায়।
উদাহরণস্বরূপ পাম তেলের কথা বলা যেতে পারে। এটি ভোগ্যপণ্যগুলোর প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। চাহিদা মেটাতে গিয়ে পাম উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে বন উজাড় হচ্ছে এবং অনেক প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। একটি পণ্যের উপাদানগুলো টেকসইভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করার সর্বোত্তম উপায় হলো, প্যাকেজিংয়ে ফেয়ার ট্রেড এবং রেইনফরেস্ট অ্যালায়েন্স, পেটা সার্টিফায়েড ইত্যাদি লোগোগুলো খুঁজে দেখা।
ছবি: সাইফুল ইসলাম ও পেকজেলসডটকম